ঢাকায় রিকশার ব্যাপক বিশৃঙ্খলা, কর্তৃপক্ষ নীরব
জনবহুল রাজধানী ঢাকার সর্বত্র রিকশার সংখ্যা বাড়ায় তীব্র যানজট হলেও এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে কর্তৃপক্ষ অনীহা দেখিয়ে আসছে বলে অভিযোগ করছেন নগরবাসীরা। বর্তমানে ঢাকার ১০ শতাংশ বাসিন্দা ব্যক্তিগত যানবাহন ব্যবহার করেন, ২৫ শতাংশ গণপরিবহন, ৫ শতাংশ অটোরিকশা ও ট্যাক্সি ব্যবহার করেন।
ব্যাটারিচালিত রিকশার সংখ্যা বৃদ্ধি শহরের যানজট সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। লাইসেন্স বা আনুষ্ঠানিক অনুমোদন ছাড়াই চলাচলকারী এই যানবাহনগুলো প্যাডেল রিকশা চালকদের জন্য হতাশার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের জীবিকা নির্বাহের উপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে বলেও তারা যুক্তি দিচ্ছেন।
২০১৪ সালে ঢাকা ও চট্টগ্রামে ব্যাটারিচালিত রিকশার ওপর হাইকোর্ট নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার পরও এটি থামেনি, বরং বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২১ সালের ১৫ ডিসেম্বর জারি করা আরেকটি নির্দেশনায় এ ধরনের রিকশা আমদানি নিষিদ্ধ করা হয়। তবে ঢিলেঢালা আইন প্রয়োগের কারণে ঢাকার সড়কে এসব বাহনের লাগামহীন বৃদ্ধি ঘটছে।
অনুমোদন প্রদান এবং তথ্য বৈষম্য
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) নামে বিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) তিন দশক আগে প্যাডেল রিকশার লাইসেন্স দেওয়া বন্ধ করে দেয়। কারণ, যানজটের জন্য এসব রিকশাই ভূমিকা রাখে।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ঢাকায় অনুমোদিত রিকশার সংখ্যা ২ লাখ ২০ হাজার ৩৭৯টি, যার মধ্যে ডিএনসিসির ৩০ হাজার ১৬২টি এবং ডিএসসিসিতে ১ লাখ ৯০ হাজার ২১৭টি। কিন্তু, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) ২০১৯ সালের এক গবেষণায় ঢাকায় প্যাডেল রিকশার সংখ্যা ১১ লাখ ছাড়িয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে, যার মধ্যে মাত্র ৩ থেকে ৪ শতাংশ নিবন্ধিত রিকশা।
নেপথ্যের শক্তি
রিকশাচালকদের সাক্ষাৎকারে জানা গেছে, রাজনীতিবিদ, প্রশাসক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সম্পৃক্ততার কারণে রিকশার সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা চ্যালেঞ্জিং। এই গোষ্ঠীগুলো রিকশা খাতের মুনাফা এবং সরকারি রাজস্বে এর ন্যূনতম অবদান বিবেচনা করে অবৈধভাবে রিকশা পরিচালনার সুরক্ষা এবং সহায়তা করে বলে অভিযোগ রয়েছে।
এক দশকের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন প্যাডেল রিকশাচালক জব্বার শোষণের গল্প শোনান: ‘আমরা যে অর্থ উপার্জন করি, তার বেশিরভাগই মালিকদের দিতে হয়। আমরা প্রতিদিনের সঞ্চয়, রাস্তার খরচ এবং যেকোনো ক্ষতির জন্য অর্থ দিয়ে থাকি। একটি রিকশা হারিয়ে গেলে কিস্তিতে তার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। রিকশার মালিকানা ব্যয়বহুল এবং এলাকার উপর নির্ভর করে। গুলশান ও বনানীর মতো জায়গায় বাড়তি বিনিয়োগের প্রয়োজন হয়। আমরা প্রতিদিন কঠোর পরিশ্রম করছি, কিন্তু খুব কম আয় করি। ‘
আরেক রিকশাচালক সুমন আলী জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান ব্যয় এবং ব্যাটারিচালিত রিকশার সঙ্গে প্রতিযোগিতার কারণে সৃষ্ট সমস্যার কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘এখন সবকিছুর দাম বেশি, তবে ব্যাটারিচালিত রিকশা আমাদের যাত্রীদের নিয়ে যাওয়ার কারণে আমাদের পক্ষে এটি আরও কঠিন হয়ে পড়েছে। মানুষ প্রায়ই আমাদের চেয়ে তাদের (ব্যাটারিচালিত রিকশা) বেশি পছন্দ করে।’
রিকশার মালিকানায় বিনিয়োগ
বিনিয়োগকারীদের জন্য রিকশার মালিকানা একটি লাভজনক সুযোগ করে দেয়। একটি নতুন বা মেরামত করা রিকশার ভাড়া প্রায় ২০ হাজার টাকা। আর এমন রিকশার জন্য দৈনিক জমা দিতে হয় ২০০ টাকা।
পাঁচটি রিকশার জন্য এক লাখ টাকা বিনিয়োগ করলে ছয় মাসের মধ্যে লাভবান হতে পারেন বিনিয়োগকারী। প্রতি সাড়ে ৫ মাসে ১০ শতাংশ ক্ষতির হার ধরে ৩ বছর ২ মাসে তাত্ত্বিকভাবে ৩২০টি রিকশার বহর তৈরি করতে পারেন তিনি। এতে পার্কিং ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় বাদ দিলে মাসিক আয় হবে ৬ লাখ ১২ হাজার টাকা।
সাংগঠনিক শোষণ
ঢাকা বিভাগ রিকশা ও ভ্যান মালিক সমিতি এবং বাংলাদেশ রিকশা মালিক লীগসহ বেশ কয়েকটি সংগঠনের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে রিকশার নম্বর প্লেট দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
ডিএসসিসি নিশ্চিত করেছে, ১৯৮৬ সাল থেকে রিকশার লাইসেন্স দেওয়া হয়নি। তবুও এই সংস্থাগুলো আদালতের স্থগিতাদেশের কথা উল্লেখ করে অনুমোদন দেওয়া অব্যাহত রেখেছে।
রিকশার গুরুত্ব
এসব প্রতিকূলতা সত্ত্বেও রিকশা ঢাকার পরিবহন ও অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো যাতায়াত, স্কুলে যাওয়া-আসা এবং বিনোদনমূলক উদ্দেশ্যে বিশেষত বর্ষার সময় ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। হিসাব অনুযায়ী, সারা বাংলাদেশে ১০ থেকে ৪০ লাখ রিকশা চলাচল করে, যারা প্রতিদিন আড়াই কোটি যাত্রী পরিবহন করে।
কিন্তু অটোরিকশার অতিরিক্ত বৃদ্ধির কারণে যানজট বেড়েছে। ফলে সড়ক দুর্ঘটনা ও অতিরিক্ত গতির কারণে নিরাপত্তা ঝুঁকিসহ বাড়তি চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে। অনেক অটোরিকশা চালকের অভিজ্ঞতাও নেই, যারা সড়ক ব্যবহারকারীদের আরও বিপদে ফেলছে।
যদিও রিকশা পরিবেশবান্ধব এবং কোনো ক্ষতিকর নিঃসরণ করে না, কিন্তু এগুলোর ধীর গতি ও ক্রমবর্ধমান সংখ্যা ঢাকার যানজট বৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে।
একটি সাংস্কৃতিক প্রতীক
বিশ্বে সবচেয়ে বেশি রিকশা চালানোর রেকর্ড রয়েছে বাংলাদেশে। শুধু ঢাকায় এর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ প্রতিদিন চলাচল করছে। ২০২৩ সালে রিকশা ও রিকশাশিল্পকে বাংলাদেশের অস্পষ্ট সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয় ইউনেস্কো। রিকশার ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধি, বিশেষ করে ব্যাটারিচালিত রিকশার বিষয়ে কর্তৃপক্ষের দ্রুত হস্তক্ষেপের দাবি রাখে। কার্যকর নিয়ন্ত্রণ ও প্রয়োগ ছাড়া পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যা ঢাকার ইতোমধ্যে চাপযুক্ত পরিবহন ব্যবস্থাকে আরও অচল করে দেবে।
-ইত্তেফাক