এমপি আনার খুন: খুনের সরঞ্জাম কিনে দিয়ে কলকাতা ছাড়েন শাহীন
কলকাতার নিউ টাউন থেকে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার ভাঙ্গরের হাতিশালার দূরত্ব প্রায় ২২ কিলোমিটার। ঝিনাইদহের সংসদ সদস্য মো. আনোয়ারুল আজীমকে (আনার) নিউ টাউনের সঞ্জিভা গার্ডেনে হত্যার পর হাতিশালার জিরেনগাছি সেতুর কাছে লাশের টুকরো ভর্তি ব্যাগ ফেলে খুনিরা। টুকরো করা সেই লাশের খোঁজে গ্রেপ্তার জিহাদকে নিয়ে গতকাল শুক্রবার ওই খালে অভিযান চালায় কলকাতা পুলিশ। তবে লাশের সন্ধান মেলেনি। আজ আবারও তল্লাশির কথা রয়েছে।
তদন্তসংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, এমপি আজীম হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী আখতারুজ্জামান শাহীন সবকিছু ঠিকঠাক করে দিয়ে কলকাতা ত্যাগ করেন। এমনকি ১০ মে বাংলাদেশে আসার আগে কলকাতায় হত্যার সরঞ্জাম কিনে দেন তিনি। হত্যা মিশনের নকশা বেয়াই শিমুল ভূঁইয়াকে বুঝিয়ে দেন তিনি। এর পর শিমুল তাঁর ভাড়াটে খুনি দিয়ে ‘কিলিং মিশন’ সম্পন্ন করেন। এরপর ‘কাট-আউট’ পদ্ধতি ব্যবহার করে লাশের টুকরো গায়েব করা হয়। আজীমকে হত্যার পর লাশের টুকরো দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার একটি খালে ফেলা হয়েছে। তবে গায়েব করা লাশের টুকরো পাওয়া নিয়ে দেখা দিয়েছে সংশয়।
এদিকে হত্যার ঘটনায় আরও অন্তত দু’জন ঢাকায় গোয়েন্দা নজরদারিতে রয়েছে। তাদের গ্রেপ্তারে গতকাল রাতে অভিযানও চালায় পুলিশ। শাহীনের সঙ্গে আরও কোনো রাঘববোয়াল রয়েছে কিনা তা নিয়ে তদন্ত চলছে। তবে ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান সমকালকে বলেন, ‘মূল পরিকল্পনাকারী শাহীনকে পাওয়া গেলে এ হত্যা মিশনের সঙ্গে রাঘববোয়াল কেউ রয়েছে কিনা বেরিয়ে আসবে। এখন পর্যন্ত শাহীনের বাইরে প্রভাবশালী অন্য কারও সংশ্লিষ্টতা আমরা পাইনি। কোনো রাজনৈতিক নেতা জড়িত– এমন তথ্যও পাওয়া যায়নি।’ শাহীনই হত্যার সরঞ্জাম কিনে দিয়ে কলকাতা ছাড়েন বলে জানান তিনি।
তিনজন ৮ দিনের রিমান্ডে
এমপি আজীম হত্যায় জড়িত অভিযোগে গ্রেপ্তার তিনজনকে আট দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। গতকাল ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট দিলরুবা আফরোজ তিথি এই রিমান্ড মঞ্জুর করেন। তারা হলেন– শিমুল ভূঁইয়া ওরফে সৈয়দ আমানুল্লাহ আমান, ফয়সাল আলী ওরফে সাজি ও সেলিস্তি রহমান। এর আগে বাংলাদেশে আসা ভারতীয় গোয়েন্দাদের একটি প্রতিনিধি দল তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে। গতকাল কোনো আইনজীবী আসামিদের পক্ষে রিমান্ড শুনানিতে দাঁড়াননি। রাষ্ট্রপক্ষে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের অতিরিক্ত পিপি আব্দুস সাত্তার দুলাল বলেন, ‘ঘটনা নৃশংস। এভাবে কাউকে হত্যা করা যায় ভাবলে গা শিউরে ওঠে। সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে অবশ্যই এ মামলায় রিমান্ড পাওয়া উচিত।’
আরও তিনজনের হদিস নেই
হত্যার সঙ্গে জড়িত সাতজনের মধ্যে চারজনকে এখনও গ্রেপ্তার করা যায়নি। তারা হলেন– মূল পরিকল্পনাকারী আখতারুজ্জামান শাহীন, ভাড়াটে খুনি সিয়াম, ফয়সাল ও মোস্তাফিজ। শাহীন এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন বলে জানা যায়। ভোলার বাসিন্দা সিয়াম গত ১৭ মে ভারত থেকে নেপালে গেছেন। আর ফয়সাল-মোস্তাফিজের ব্যাপারে কিছু জানা যাচ্ছে না। তারা দু’জই খুলনার বাসিন্দা এবং শাহীনের পরিচিত। হত্যাকাণ্ডের জন্য তাদের নতুন পাসপোর্ট করে কলকাতায় নেওয়া হয়। মিশন শেষে তারা দেশে ফেরেন।
এ ছাড়া হত্যার পরিকল্পনাকারী শাহীনের পেছনে আর কেউ রয়েছেন কিনা– তা তদন্ত করছেন গোয়েন্দারা। এমপি আজীমের কার কার সঙ্গে দ্বন্দ্ব ছিল তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত তথ্য মিলছে– স্বর্ণ চোরাচালানসহ অবৈধ কারবারের বিরোধ ঘিরেই তিনবারের সংসদ সদস্য আজীমকে হত্যা করা হয়েছে।
কাঠগড়ায় কাঁদলেন সেলিস্তি
আদালতে তোলার সময় ক্যামেরা দেখে মুখ লুকান সেলিস্তি রহমান। পরে আদালতের ডকে তোলা হলে তিনি কাঁদতে থাকেন। শুনানির আগে তিনি বলেন, ‘আমি কীভাবে আসামি হই! আমি শুধু ওই বাসায় ছিলাম। তাছাড়া কিছুই জানি না।’
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, গত ১৩ মে কলকাতায় এমপি আজীম খুন হওয়ার দু’দিন পর ঢাকায় ফেরেন হত্যা মিশনের সমন্বয়ক শিমুল ভূঁইয়া। তাঁর সঙ্গে একই ফ্লাইটে ঢাকায় ফেরেন শাহীনের বান্ধবী সেলিস্তি রহমান। বিমানবন্দর থেকে চলে যান বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় শাহীনের অভিজাত ফ্ল্যাটে। ওই রাতে শাহীন সেখানে পার্টির আয়োজন করেন। এর আগে ৩০ এপ্রিল শাহীন ও শিমুলের সঙ্গে কলকাতায় যান সেলিস্তি। শাহীন ১০ মে দেশে ফিরলেও সেলিস্তিকে রাখা হয় কলকাতায়। এর আগে গত জানুয়ারিতে সেলিস্তিকে কলকাতায় নিয়ে যান শাহীন। সেলিস্তির গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলের নাগরপুরে। থাকেন উত্তরার অভিজাত ফ্ল্যাটে। গোয়েন্দারা বলছেন, সেলিস্তিকে ‘হানি ট্র্যাপ’-এর কাজে ব্যবহার করতে কলকাতায় রেখে আসেন শাহীন। হত্যায় সরাসরি তাঁর সংশ্লিষ্টতার তথ্য এখনও মেলেনি।
প্রমাণ না রাখতে টুকরো করা হয় লাশ
তদন্তসংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোনো প্রমাণ না রাখতেই হত্যার পর এমপি আজীমের লাশ টুকরো টুকরো করা হয়। গতকাল ডিবির রিমান্ড আবেদনে বলা হয়, আজীমের সঙ্গে ব্যবসায়িক মিটিংয়ের কথা বলে তাঁকে কলকাতায় যেতে বলেন শাহীন। তবে ১০ মে শাহীন দেশে চলে আসার কথা জানতেন না আজীম। আসার সময় শিমুলকে সব দায়িত্ব দিয়ে শাহীন বলেন– কোনো ভুল যেন না হয়। হত্যাকাণ্ডের প্রমাণ যাতে না থাকে।
সিসি ক্যামেরায় ঘাতকদের চেহারা
কলকাতার নিউ টাউনে যে ফ্ল্যাটে এমপি আজীমকে হত্যা করা হয়, সেখানকার দুটি সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সমকালের হাতে এসেছে। একটি ফুটেজে ১৩ মে দুপুরে এমপি আজীমকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফ্ল্যাটে ঢুকতে দেখা যায়। এ সময় তাঁর পরনে ছিল কালো প্যান্ট ও সাদা শার্ট। হাতে ছিল কাগজপত্রসহ ফাইল। একই সময় অন্য দু’জন ফ্ল্যাটে ঢোকেন। তদন্তসংশ্লিষ্টরা বলছেন, তাদের একজন হলেন শিমুল ভূঁইয়া ও অন্যজন ভাড়াটে কিলার ফয়সাল।
অন্য একটি ফুটেজে ওইদিন বিকেল ৫টা ৫ মিনিটে দু’জনকে ফ্ল্যাট থেকে বের হতে দেখা যায়। তাদের একজনের হাতে ছিল একটি সবুজ রঙের বড় ট্রলিব্যাগ। আরেকজনের হাতে কয়েকটি পলিথিন ব্যাগ। তারা লিফটে নামেন। গোয়েন্দারা বলছেন, ওই ব্যাগে ছিল এমপির লাশের অংশ। ব্যাগ নিয়ে নামেন শিমুল ও আরেক ভাড়াটে কিলার জিহাদ।
কোনো প্রশ্নের জবাব দেয়নি জিহাদ
এমপি আজীম হত্যায় জড়িত থাকার বিষয়ে বাংলাদেশি যুবক জিহাদকে গ্রেপ্তার করেছে কলকাতা পুলিশ। শুক্রবার সকালে তাকে বারাসাত আদালতে তুলে সিআইডি ১৪ দিনের রিমান্ডের আবেদন করে। আদালত ১২ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এর কিছুক্ষণ পর জিহাদকে নিয়ে অভিযানে বের হয় সিআইডি। কঠোর নিরাপত্তায় এদিন জিহাদকে আদালতে তোলা হয়। এ সময় তার মুখ ঢাকা ছিল কাপড়ে। কোমরে রশি বেঁধে তাকে আদালতে নেওয়া হয়। সাংবাদিকরা নানা প্রশ্ন করলেও কোনো উত্তর দেয়নি জিহাদ। আদালতে জিহাদের হয়ে কোনো আইনজীবী দাঁড়াননি। এর আগে বৃহস্পতিবার পশ্চিমবঙ্গের বনগাঁ থেকে জিহাদকে গ্রেপ্তার করা হয়।
লাশের খোঁজে তল্লাশি
গ্রেপ্তার জিহাদকে নিয়ে গতকাল বিকেলে নিউ টাউন থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে ভাঙ্গরের কৃষ্ণমাটি জিরানগাছা খাল ও আশপাশে এমপি আজীমের মরদেহের তল্লাশি চালায় কলকাতা পুলিশ। সিআইডি কর্মকর্তাদের পাশাপাশি পোলেরহাট থানার পুলিশও অভিযানে অংশ নেয়। দুর্যোগ মোকাবিলা দল নামানো হয়। লাশের অংশ খুঁজতে ড্রোন ওড়ায় পুলিশ।-সমকাল
এবিসিবি/এমআই