সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি স্থবির
দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে গত এক মাসের বেশি সময় বিভিন্ন সেক্টরে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। তার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচির কার্যক্রমেও। যথাযথ সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই গত বছরের আগস্টে চালু হওয়া এ কার্যক্রমে নেমে এসেছে স্থবিরতা। আগের দুই মাসে এ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা দুই লাখ ছাড়িয়ে গেলেও গত দেড় মাসে মাত্র ২০ হাজার নতুন গ্রাহক যুক্ত হয়েছেন। এ কার্যক্রম জোরদার ও পেনশন কর্তৃপক্ষের প্রাতিষ্ঠানিক রূপরেখা নির্ধারণে ৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকার নতুন প্রকল্প নেওয়ার কথা থাকলেও আপাতত তা হচ্ছে না। সার্বিকভাবে এ কর্মসূচিতে এক ধরনের অনিশ্চয়তা ভর করেছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় ও জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, পুরোপুরি প্রস্তুতি না নিয়েই ভোটের আগে জনগণকে তুষ্ট করতে তড়িঘড়ি করে এ কর্মসূচি নেয় ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার। শুরুর সময়েই প্রস্তুতির ঘাটতির অভিযোগ তুলে এ কার্যক্রমের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন অর্থনীতিবিদরা।
নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, এত বড় কর্মযজ্ঞ শুরুর আগে যে ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া দরকার ছিল, তা নেওয়া হয়নি। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চাওয়ায় অর্থ বিভাগের তেমন কোনো মতামত না নিয়েই এ পেনশন কার্যক্রম শুরু করতে সম্মত হন সাবেক অর্থ সচিব আবদুর রউফ তালুকদার।
তারা বলছেন, এ কারণেই এতে অন্তর্ভুক্তির চাঁদা ও পরবর্তী সময়ে পেনশন সুবিধা পাওয়া নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়। বিশেষ করে পেনশন দেওয়ার ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতির হারকে যথাযথভাবে আমলে নেওয়া হয়নি। তবে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এ কার্যক্রম বন্ধ করে দেবে– এমন কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এখন পর্যন্ত এর আওতায় চালু থাকা চারটি স্কিমই আপাতত স্বাভাবিক নিয়মে চলবে। তবে বাস্তবতার আলোকে এ কর্মসূচিতে কিছু পরিবর্তন আনা হতে পারে।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছরের ১৭ আগস্ট আনুষ্ঠানিকভাবে সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচির উদ্বোধন করেন। সেদিন থেকেই বেসরকারি খাতের চাকরিজীবীদের জন্য ‘প্রগতি’, স্বকর্মে নিয়োজিত ব্যক্তিদের জন্য ‘সুরক্ষা’, প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য ‘প্রবাসী’ এবং নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর জন্য ‘সমতা’– এই চার স্কিম সবার জন্য উন্মুক্ত। উদ্বোধনের পর প্রথম এক মাসে চার স্কিমে গ্রাহক বেড়ে দাঁড়ায় ১২ হাজার ৮৮৯-তে। এর পর কয়েক মাস গ্রাহক সংখ্যা কমলেও ষষ্ঠ মাস থেকে চাঁদাদাতার হার বাড়তে থাকে। চালুর আট মাস পর নিবন্ধন সম্পন্নকারীর সংখ্যা এক লাখের মাইলফলক স্পর্শ করে। এর পর মে ও জুন মাসেও বিপুল সংখ্যক মানুষ নিবন্ধন সম্পন্ন করে চাঁদা জমা দেন। এ দুই মাসে দুই লাখের বেশি মানুষ এ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেন। এতে গত ৮ জুলাই পর্যন্ত চার ধরনের পেনশন স্কিমে গ্রাহক সংখ্যা দাঁড়ায় ৩ লাখ ৫২ হাজারে। তবে এর পরের ৪৯ দিনে গত মঙ্গলবার পর্যন্ত এ কর্মসূচিতে নতুন গ্রাহক হয়েছেন মাত্র ১৯ হাজার ৯৫৯ জন। বিশেষ করে গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর এ সংখ্যা একেবারেই কমে আসে। গত ২৭ আগস্ট পর্যন্ত কর্মসূচিতে ৩ লাখ ৭১ হাজার ৯৬৯ জন গ্রাহক ১২০ কোটি ৩১ লাখ টাকার কিছু বেশি চাঁদা জমা দিয়েছেন।
এদিকে গত ১ জুলাই থেকে নতুন যুক্ত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ রাষ্ট্রায়ত্ত, স্বায়ত্তশাসিত, স্বশাসিত ও বিধিবদ্ধ সংস্থার চাকরিজীবীর জন্য প্রত্যয় স্কিম চালু করার সিদ্ধান্তের কথা জানায় অর্থ মন্ত্রণালয়। তবে প্রত্যয় স্কিম বাতিলের দাবিতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এক মাসের বেশি সময় আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে এটি বাতিল করতে বাধ্য হয় বিগত সরকার। আগামী বছরের ১ জুলাই থেকে সব ধরনের সরকারি চাকরিতে যোগ দেওয়া নতুন চাকরিজীবীদের এ কর্মসূচির আওতায় পেনশন দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হলেও পরে পিছিয়ে এসেছে সরকার।
সর্বজনীন পেনশন কার্যক্রম জোরদার ও পেনশন কর্তৃপক্ষের প্রাতিষ্ঠানিক রূপরেখা নির্ধারণ করতে একটি প্রকল্প হাতে নেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। ‘সর্বজনীন পেনশন পদ্ধতি শক্তিশালীকরণ’ শীর্ষক এ প্রকল্পের আওতায় সার্বিকভাবে এ কর্মসূচির ভবিষ্যৎ নিয়ে সম্ভাব্যতা যাচাই করারও উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলা হয়। প্রাথমিকভাবে প্রকল্পটির মেয়াদ ধরা হয় ২০২৪ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৮ সালের জুন পর্যন্ত। ব্যয় হবে ৩২ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার, স্থানীয় মুদ্রায় যা ৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে এডিবির ঋণ হবে ২৫ কোটি ডলার এবং ৭ কোটি ৫০ লাখ ডলারের তহবিল জোগাবে সরকার। এ প্রকল্প জরুরি ভিত্তিতে নীতিগত অনুমোদনের জন্য গত ২৩ জুন পরিকল্পনা কমিশনে পাঠায় অর্থ মন্ত্রণালয়।
কিন্তু পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এটির অনুমোদন না দিয়ে বৈদেশিক অর্থায়ননির্ভর হওয়া প্রকল্পকে পাইপলাইনে রাখা হয়। বৈদেশিক ঋণের চাপ কমাতে পাইপলাইনের এসব প্রকল্প যথাযথভাবে পর্যালোচনার পর সিদ্ধান্ত হবে বলে জানিয়ে দিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন। প্রকল্পটি এখনও স্থগিত কিংবা বাতিল না হলেও অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বর্তমানে সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচির যে অবস্থা, তাতে এ প্রকল্প আপাতত হচ্ছে না বলেই তারা আভাস পেয়েছেন। সবকিছু মিলিয়ে বর্তমানে সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে।
এ বিষয়ে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের সদস্য মো. গোলাম মোস্তফা সমকালকে বলেন, প্রকল্পটি খুব প্রাথমিক পর্যায়ে ছিল। বর্তমানে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অন্যান্য বিষয় অগ্রাধিকার পাচ্ছে। এটিও হয়তো হবে, তবে এ ক্ষেত্রে একটু সময় লাগবে। কারণ, এটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নতুন সরকারের সিদ্ধান্ত প্রয়োজন হবে।
এ প্রকল্পের আওতায় নতুন করে সম্ভাব্যতা যাচাই করার বিষয়টি উল্লেখ ছিল। তাহলে কি কার্যক্রম শুরুর আগে সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়নি– এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এটি দেখভাল করছে অর্থ বিভাগ। তারাই বিষয়টি বিস্তারিত বলতে পারবে।
সরকার পরিবর্তন হলে এটি বন্ধ হয়ে যেতে পারে– এমন শঙ্কাও ছিল অনেকের মনে, এ কর্মসূচির ভবিষ্যৎ কী– এমন প্রশ্নে গোলাম মোস্তফা বলেন, বন্ধ হয়ে যাবে বলে আমি মনে করি না। কারণ, এটি আইনের আওতায় প্রতিষ্ঠিত সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের অধীনে পরিচালিত একটি রাষ্ট্রীয় স্কিম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, যথাযথ সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই খুব তড়িঘড়ি করে এ কর্মসূচি চালু হয়েছিল। সে কারণে এ স্কিম থেকে সুবিধা পাওয়ার বিষয়গুলোও পরিষ্কার ছিল না। এ ধরনের ধোঁয়াশাযুক্ত কর্মসূচির ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কা থাকবেই। তাই দেশের অর্থনীতিতে এ কার্যক্রমের যৌক্তিকতা কতটুকু, তা নির্ধারণে পুনরায় এটির রিভিউ করা দরকার।
তিনি আরও বলেন, এটি যদি ভালো হয়, তাহলে চালু রাখতে সমস্যা নেই। তবে রিভিউ করার পর যদি মনে হয়, এটি নিয়ে পুনর্বিবেচনা করার সুযোগ রয়েছে, তাহলে সেটি করা যেতে পারে।
-সমকাল