বাংলাদেশে কীভাবে আসছে কোকেন?

বাংলাদেশে ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে গত ২৫ জানুয়ারি আফ্রিকার দেশ মালাউয়ির এক নাগরিকের কাছ থেকে আট কেজি তিনশ গ্রাম কোকেন উদ্ধার করা হয়। পরে ওই ব্যক্তির তথ্যের ভিত্তিতে আফ্রিকান আরো তিনজন নাগরিকসহ ওই চক্রের পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়।
রোববার মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মুস্তাকিম বিল্লাহ ফারুকী জানিয়েছেন, বাংলাদেশে এটাই এখন পর্যন্ত কোকেনের সবচেয়ে বড় চালান। যা মালাউয়ি থেকে ইথোপিয়া ও দোহা হয়ে ভারতে পাচারের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে আসে। বাংলাদেশকে রুট হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। এই চালানের আর্থিক মূল্য একশো কোটি টাকার বেশি।
এখন প্রশ্ন হলো কোকেন সেবনে কী ধরনের শারীরিক ক্ষতি হয়? কোকেন কোন ধরনের মাদক?

চিকিৎসকরা বলছেন, কোকেন মূলত উদ্দীপক মাদক। কোকেনের কারণে মানুষের শরীরে দুই ধরনের ক্ষতি হয়। স্বল্পমেয়াদে ও দীর্ঘমেয়াদে মারাত্মক স্বাস্থ্যগত ও মানসিক ঝুঁকির মধ্যে পড়ে কোকেন সেবনকারী ব্যক্তি।
কোকেন গ্রহণের ৪৮ ঘণ্টা পরেও প্রস্রাবে এর উপস্থিতি থাকে। যা অন্য মাদকে থাকে না। এছাড়া অন্য মাদকসেবীদের চেয়ে কোকেনসেবীদের ২৪ গুণ বেশি হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা থাকে।

কোকেন সেবনকারীর যেসব শারীরিক ও মানসিক সমস্যা হয়
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, কোকেন সেবনকারীরা অতিরিক্ত উত্তেজনায় ভোগে। অতিরিক্ত কথাবার্তা বলে। নাক দিয়ে অনবরত পানি পড়ে। নাক দিয়ে অনেক সময় রক্তপাত হয়।
কোকেনের প্রতিক্রিয়ায় ঘুম কমে যায়, ক্ষুধা মন্দাভাব হয়, ওজন কমে যায়। অতিরিক্ত কোকেন সেবনের ফলে হার্টবিট বেড়ে যায়, যা রক্ত সঞ্চালনে বাধা দেয়। ফলে হার্ট অ্যাটাক হয়।
অতিরিক্ত কোকেন সেবনে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হতে পারে। স্ট্রোকের মতো ঘটনা ঘটে।
বাংলাদেশে মাদক বিরোধী প্রচারণা করে এমন একটি সংগঠন মানস। এর প্রতিষ্ঠাতা ডা. অরূপ রতন চৌধুরী বিবিসি বাংলাকে বলেন, “অন্য মাদকসেবীদের চেয়ে কোকেন সেবনকারীদের ২৪ গুণ বেশি হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা থাকে। কোকেন এমন ধরনের মাদক যা সেবন করার ৯০ দিন পরও শরীরে যার উপস্থিতি পাওয়া যায়। ৯০ দিন পরও সেবনকারীর চুল পরীক্ষা করলে কোকেন সেবনের প্রমাণ পাওয়া যায়”।
কোকেন সেবনকারীদের প্রথম পর্যায়ে অনেক সেবনকারী আত্মবিশ্বাস বেড়ে যাওয়ার কথা বলে থাকলেও দীর্ঘমেয়াদে এটি তাদের বিষণ্ণতা, অবসন্নতার দিকে ঠেলে দেয়।
চরম মাত্রায় সেবনকারীর মুড সুইং হয়, অনেক সময় বিপজ্জনক আচরণ করে।
কোকেন আসক্তদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিকিৎসকরা বলে থাকেন, এরা প্রচণ্ড পরিমাণে নোংরা হয়ে যায়, স্বাস্থ্যগত নানা বিষয় ভুলে যায়। নাকের মধ্যে সাদা পাউডারের মতো কোকেনের পাউডার লেগে থাকে।
আরেকটি লক্ষণীয় বিষয় হলো কোকেন সেবনকারীরা একাকী থাকতে পছন্দ করে, ফলে অসামাজিক হয়ে পড়ে। স্বভাবগতভাবে দুর্বিনীত হয়ে যায় এরা।
এটি মিথ্যা কল্পনার জগতে নিয়ে যায় সেবনকারীকে। স্বল্পমাত্রায় কোকেন সেবন মাদকাসক্তদের তাৎক্ষণিক আনন্দ দিলেও এক সময় এডিকশানের দিকে চলে যায়। ফলে কোকেন নেয়ার মাত্রা বেড়ে যায়।

কোকেন দুইভাবে সেবন করে মাদকাসক্তরা। প্রথমত নাক দিয়ে টেনে নেয় কিংবা সিগারেটের সাথে নেয় এবং দ্বিতীয়ত ইনজেকশনের মাধ্যমে পুশ করা হয় শরীরে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ও মেডিসিন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ছিলেন খান আবুল কালাম আজাদ।
তিনি বলেন, “কেউ কেউ আবার হেরোইন ও কোকেন মিলিয়ে একটা আলাদা মিশ্রণ তৈরি করে। এটাকে বলে ‘স্পিট বল’। কোকেন মস্তিষ্ককে উদ্দীপন করে আবার হেরোইন মানুষের নার্ভাস সিস্টেমকে বিষণ্ণতায় ফেলে। এই দুইয়ের মধ্যে তারা একটা বিপরীতধর্মী প্রতিক্রিয়া পাওয়ার চেষ্টা করে”।
“মস্তিষ্কে সবসময় কোকেনের চাহিদা তৈরি হয় ফলে তা না পেলে তাদের বিষণ্ণতা বোধ তৈরি হবে। একসময় ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে তাদের আচরণ। যারা কোকেন নেয় তারা ধীরে ধীরে বিয়ার, অ্যালকোহল, ফেনসিডিলসহ অন্য ধরনের মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ে।”
অর্থাৎ কোকেন সেবনকারীরা ‘পলিড্রাগ এবিউজার’ এ পরিণত হয় বলে জানান মি. আজাদ।

কোকেন কী ও কোথায় হয়?
কোকেন মূলত ‘উদ্দীপক মাদক’ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কোকা পাতা থেকে কোকেন তৈরি হয়।
এই পাতাকে পরিশুদ্ধ করে বেইজ তৈরি করা হয়। পরে অ্যামোনিয়া, সোডিয়াম বাই কার্বনেট বা সালফিউরিক এসিড এবং পানি দিয়ে এটি পাউডার হিসেবে তৈরি করা হয়।
দক্ষিণ আমেরিকার বেশ কয়েকটি দেশে এই পাতার চাষ বেশি হয়। সেখান থেকেই সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে এটি। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে দুইশ-আড়াইশ ফুট উপরে কোকা পাতা উৎপাদন হয়।
জাতিসংঘের অপরাধ ও মাদক বিষয়ক কার্যালয় (ইউএনওডিসি)র ‘গ্লোবাল কোকেন রিপোর্ট ২০২৩’ এ বলা হয়েছে, ২০২০ সালে বিশ্বের মোট কোকেনের ৬১ শতাংশ কলম্বিয়াতে উৎপাদন হয়েছে।
এসময় পেরুতে ২৬ শতাংশ, বলিভিয়া ও আশেপাশের এলাকায় ১৩ শতাংশ কোকেন উৎপাদিত হয়েছে বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের চিফ কেমিক্যাল এক্সামিনার দুলাল কৃষ্ণ সাহা জানান, বর্তমান ইরাক এক সময়ের মেসিডোনিয়াতে কোকা পাতার উৎপাদন বেশি হতো। সে সময় মেসিডোনিয়ার রাখালরা তাদের ভেড়াগুলোকে মাঠে ছেড়ে দিতো। ওই পাতা ভেড়ার খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
কোকা পাতাকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ার পর এক কেজি কোকেন তৈরি করতে বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৩৫ কোটি টাকার বেশি ব্যয় হয়। তাই এটি বিশ্বজুড়েই বেশ দামি মাদক। কোকেন ব্যবসায়ীদের ‘ব্যারোন’ বলা হয়।
বাংলাদেশের ‘মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৮’ তে, কোকেনকে গুরুতর অপরাধ বিবেচনা করে ‘ক’ শ্রেণীভুক্ত করা হয়েছে।
এই আইনে, ২৫ গ্রামের বেশি কোকেনসহ কোনো ব্যক্তি ধরা পড়লে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ঢাকা বিভাগীয় প্রধান অতিরিক্ত পরিচালক মুজিবুর রহমান পাটোয়ারি জানান, “আগামী মাসে কোকেন পাচারের ২০১৩ সালের এক মামলার রায় দেয়ার কথা রয়েছে”।
বাংলাদেশে ধরা পড়া এবারের চালানটিই কঠিন অবস্থায় আসা কোকেনের সবচেয়ে বড় চালান।
“আফ্রিকার নাগরিকদের মাধ্যমে এটি দেশে আসলেও মূলত রুট হিসেবে এ দেশকে ব্যবহার করা হয়েছে”, জানান মি. সাহা।
“মাঝখানে এটা একেবারেই থেমে যায়। সরকার মাদকের বিষয়ে খুব কঠোর। খুব শিগগিরই ফরেনসিক অ্যানালাইসিস করে রিপোর্ট দেয়া হবে”।
রুট হিসেবে বাংলাদেশকে ব্যবহার
বাংলাদেশে এর আগে যত কোকেনের চালান ধরা পড়েছিলো বেশিরভাগই এসেছিলো দক্ষিণ আমেরিকা থেকে।
২০১৫ সালে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দরে সূর্যমুখী তেলের ঘোষণা দিয়ে আমদানি করা একটি ড্রামে কোকেনের চালান পাওয়া যায়।
দক্ষিণ আমেরিকার দেশ বলিভিয়া থেকে আনা একটি কন্টেইনারে ১০৭টি ড্রামের মধ্যে একটি ড্রামে তরল অবস্থায় কোকেনের অস্তিত্ব পাওয়া যাওয়ার কথা জানিয়েছিলো শুল্ক বিভাগের গোয়েন্দারা।
সে সময় গোয়েন্দারা জানিয়েছিলেন, ড্রামটিতে ১৮৫ কেজি তরল ছিল এবং তাতে এর এক-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ প্রায় ৬০ কেজি কোকেন ছিল।
কোকেন পাচারের মধ্যবর্তী রুট হিসেবে বাংলাদেশকে ব্যবহার করা হচ্ছে বলেও জানিয়েছিলেন গোয়েন্দারা।
বাংলাদেশে হেরোইনসহ নানা ধরনের মাদক পাওয়া গেলেও কোকেনের প্রচলন কম বলেই ধারণা করা হয়।
এর আগে ২০১৩ সালে তিন কেজি কঠিন কোকেনসহ পেরুর এক নাগরিককে গ্রেফতার করা হয়।
পরের বছরও পাঁচ কেজি ২০০ গ্রামের একটি চালান ধরা পড়ে বাংলাদেশে।
২০১৫ সালে বিমানবন্দরে আবারো দুই কেজি তিনশ গ্রামের একটি চালান ধরা পড়ে। ওই মামলায় ঢাকার বিচারিক আদালত পেরুর এক নাগরিককে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন।
২০২৩ সালের জুনেও শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে এক নারীকে পৌনে দুই কেজি কোকেনসহ গ্রেফতার করা হয়।
বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে মাদক চোরাচালানের ঝুঁকি আগে থেকেই রয়েছে। কারণ পৃথিবীর দুটি প্রধান মাদক উৎপাদন ও চোরাচালানের কেন্দ্র গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল ও গোল্ডেন ক্রিসেন্টের ঠিক মাঝখানে বাংলাদেশের অবস্থান।
ইউএনওডিসির গ্লোবাল কোকেন রিপোর্ট অনুযায়ী, বৈশ্বিকভাবে নাইজেরিয়ান কয়েকটি চক্র এ ধরনের মাদক পাচারের বিস্তার ঘটিয়েছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ঢাকা বিভাগীয় প্রধান অতিরিক্ত পরিচালক মুজিবুর রহমান পাটোয়ারি জানান, “২০০৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে কোকেনের ১০ টি চালান ধরা পড়েছে। প্রত্যেকটিতেই বাংলাদেশকে রুট হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে”।
“তবে, শনিবার ধরা পড়া চালানটিই সবচেয়ে বড়। এখন পর্যন্ত ২০ জনকে এসব মামলায় আসামি করেছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর” জানান মি. পাটোয়ারি।-বিবিসি বাংলা
এবিসিবি/এমআই