অনলাইনে কোরবানির পশু বিক্রি ২৩০০ কোটি

করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) মহামারিতে নানা বিধিনিষেধ জুড়ে দেওয়া হয়েছে কোরবানির পশুর হাটে। এরপরও হাটগুলোতে স্বাস্থ্যবিধির কোনো বালাই নেই। এ অবস্থায় নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে অনেকেই পশু কিনছেন অনলাইন থেকে। ডিজিটাল হাটে কোরবানির পশু বিক্রি গতবারের চেয়ে এবার কয়েক গুণ বেড়েছে। গত ২ জুলাই থেকে রোববার (১৮ জুলাই) পর্যন্ত ১৭ দিনে অনলাইনে ৩ লাখ ১৮ হাজার ৫০৭টি পশু বেচাকেনা হয়েছে। দুই হাজার ২০৬ কোটি ৬২ লাখ ৪৩ হাজার ৫৬৮ টাকার পশু বেচাকেনা হয়েছে। অনলাইনে গরু কিনে কেউ ঠকবেন না বলে আশ্বস্ত করছে সরকার। ক্রেতা ধরতে অনলাইনে বিজ্ঞাপন দিচ্ছে ই-কমার্স সাইটগুলো।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এবার হাটে জমায়েত হওয়ার পরিবর্তে অনলাইন মাধ্যম থেকে পশু কেনার পরামর্শ দিয়েছেন। এ জন্য মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ দেশের জেলা-উপজেলার অনলাইন হাটগুলোকে সম্পৃক্ত করে একটি প্ল্যাটফর্মে এনেছে। ডিজিটাল হাট ডট নেট নামে এ প্ল্যাটফর্মে এক হাজার ৮৪৩টি অনলাইন শপের মাধ্যমে প্রান্তিক পর্যায়ের ২৪১টি হাটকে যুক্ত করা হয়েছে। এ পর্যন্ত অনলাইনে ১৭ লাখ ৫৩ হাজার ৫৬টি পশুর ছবি আপলোড করা হয়েছে। এরমধ্যে দুই হাজার ২০৬ কোটি ৬২ লাখ ৪৩ হাজার ৫৬৮ টাকা মূল্যে তিন লাখ ১৮ হাজার ৫০৭টি কোরবানির পশু বিক্রি হয়েছে।
এরমধ্যে গরু-মহিষ বিক্রি হয়েছে ২ লাখ ৪৪ হাজার ৯১০টি এবং ছাগল-ভেড়া বিক্রি হয়েছে ৭৩ হাজার ৫৯৭টি। পশু বিক্রির দিক দিয়ে শীর্ষে রয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগ। এ বিভাগে এক লাখ ২৪ হাজার ৪৭টি গরু-মহিষ এবং ২৫ হাজার ২৩৮টি ছাগল-ভেড়া অনলাইনে বিক্রি হয়েছে। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে রাজশাহী বিভাগ। রাজশাহীতে ২৮ হাজার ২৫৫টি গরু ও ১৮ হাজার ৫৩টি ছাগল-ভেড়া বিক্রি হয়েছে। তৃতীয় স্থানে ঢাকা বিভাগ। এ বিভাগে মোট ৪২ হাজার ৫১৪টি গরু-মহিষ এবং তিন হাজার ৭০৫টি ছাগল-ভেড়া বিক্রি হয়েছে। চতুর্থ স্থানে রংপুর বিভাগ। এ বিভাগে অনলাইন মাধ্যমে গরু-মহিষ বিক্রি হয়েছে ৩১ হাজার ৭৭৪টি ও ছাগল-ভেড়া ১৭ হাজার ১৪টি। অনলাইনে কোরবানির পশু বিক্রিতে সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছে ময়মনসিংহ বিভাগ। রোববার পর্যন্ত মাত্র এক হাজার ৮৩৯টি গরু-মহিষ ও ১১৭টি ছাগল-ভেড়া বিক্রি হয়েছে।
এছাড়া সিলেট বিভাগে তিন হাজার ৩০৬টি গরু-মহিষ এবং ৫৫৩টি ছাগল-ভেড়া, বরিশালে দুই হাজার ৪৩৪টি গরু-মহিষ ও ৪১৪টি ছাগল-ভেড়া এবং খুলনায় ১০ হাজার ৭৪১টি গরু-মহিষ এবং ৮ হাজার ৬০৩টি ছাগল-ভেড়া বিক্রি হয়েছে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গতবছর দেশে কোরবানি হয়েছিল ৯৪ লাখ ৫০ হাজার পশু। এরমধ্যে কোরবানির আগের দিন পর্যন্ত অনলাইনে মাত্র ৭০ হাজার গরু-ছাগল বিক্রি হয়েছিল। কিন্তু এবার কোরবানির কয়েকদিন আগেই তার প্রায় পাঁচ গুণ বেশি বিক্রি হয়েছে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, কোরবানির পশুর মধ্যে কমপক্ষে ২৫ শতাংশ পশু অনলাইনে বিক্রির নির্দেশনা রয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। সেই লক্ষ্য পূরণেই জেলাভিত্তিক অ্যাপ, ফেসবুক পেজ এবং সাইটে পশু বিক্রিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। করোনার ভয়াবহ পরিস্থিতি, সরকারি উদ্যোগে পশু কেনাকাটা সহজ, প্রান্তিক কৃষকের সঙ্গে ক্রেতাদের সংযোগ স্থাপন এবং লেনদেনের ক্ষেত্রে আস্থা তৈরি করার কারণে এটি সম্ভব হয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
আগামী কয়েকদিন বিক্রির পরিমাণ আরও বাড়বে বলে আশা প্রকাশ করেছেন প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (খামার) জিনাত সুলতানা। তিনি বলেন, গতবারের চেয়ে এবার করোনা পরিস্থিতি খারাপ। তাই অনলাইনে কোরবানির পশু বিক্রির সম্ভাবনাও বেশি। প্রতিবছর অনলাইন ও হাট মিলে গড়ে ৫০ থেকে ৫৫ হাজার কোটি টাকার মতো কোরবানির পশু বেচা-বিক্রি হয় বলে জানান তিনি।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরিচালক (সম্প্রসারণ) দেবাশীষ দাশ বলেন, এ বছর এখন পর্যন্ত অনলাইনে যে পরিমাণ কোরবানির পশু বিক্রি হয়েছে, এর চেয়ে বেশি প্রত্যাশা ছিল। তবে আমাদের এও প্রত্যাশা, সামনে কোরবানির বড় অংশই অনলাইনে বেচাকেনা হবে।
পশু খামার মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক শাহ ইমরান বলেন, কোরবানির পশু আয়োজন করে হাটে গিয়ে কেনার সংস্কৃতি বাংলাদেশে রয়েছে। তবে কভিডের কারণে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সেই চর্চা থেকে বাইরে এসে মানুষ অনলাইন থেকে গরু কিনছে।
অনলাইন ছাড়াও ইতোমধ্যে ঢাকার বিভিন্ন খামারেও গরু বিক্রি হচ্ছে। সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির মধ্যে হাটে গিয়ে পশু কেনা ঝুঁকিপূর্ণ মনে করে খামারকে ভালো বিকল্প বলছেন ক্রেতারা। এছাড়া তারা মনে করছেন, রাজধানীতে কোরবানির আগে নিজেদের সুবিধাজনক সময়ে খামার থেকে পশু পাওয়াটা তাদের বাড়তি সুবিধা দেবে।
বিক্রেতারা জানিয়েছেন, ক্রেতাদের কেউ কেউ অনলাইনে ছবি দেখে, তারপর খামারে এসে পছন্দ করে কিনছেন। আবার কেউ অনলাইনে সরাসরি দেখেও কিনেছেন। অনলাইনে এবার বেশি সাড়া পাচ্ছেন বলে জানান তারা।
নগরীর সবচেয়ে বড় খামার মোহাম্মদপুরের বেড়িবাঁধ এলাকার সাদেক এগ্রো ফার্মের স্বত্বাধিকারী মো. ইমরান হোসেন জানান, তাদের খামারে ঈদের জন্য দুই হাজার ২০০টি গরুর মধ্যে ইতোমধ্যে এক হাজার ৩০০টি বিক্রি হয়েছে। গতবারের চেয়ে এবার অনলাইন বিক্রি বেড়েছে।
তবে সরকার অনলাইনে পশু বিক্রিতে উৎসাহিত করলেও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রান্তিক খামারিদের অনলাইন সম্পর্কে কোনো ধারণা না থাকায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন। এ বিষয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (খামার) জিনাত সুলতানা বলেন, খামারিরা আমাদের কাছে আসছেন অথবা খামারিদের নিজস্ব ফেসবুক পেজ, ওয়েবসাইটসহ বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্মে তারা পশুর তথ্য আপলোড করছেন। সারাদেশে আমাদের কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন। তাদের মাধ্যমে খামারির আপলোড করা পশুর সুস্থতা, ওজন, দাম নজরদারি করছি। কেউ অসুস্থ পশু বা ভুল তথ্য দিলে তা সরিয়ে দিচ্ছি। আমরাই সব কিছু করে দিচ্ছি। এ নিয়ে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই।
বাংলাদেশ ডেইরি ফার্ম অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, দেশি গরু অনলাইনে ৪০০ কেজি লাইভ ওয়েটের গরু প্রতিকেজি ৪২৫ টাকা, ৪০১ থেকে ৫০০ কেজি ৪৭৫ টাকা এবং ৫০১ থেকে ৬০০ কেজি ৫২৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এর বাইরে হাইব্রিড বা বেশি ওজনের গরু অন্যান্য দামে বিক্রি করা হচ্ছে।
এদিকে ডিজিটাল হাট থেকে গরু কেনার পর সেটি ক্রেতার বাড়িতে পৌঁছে দেবেন বিক্রেতা। ঈদের আগের দিন পর্যন্ত গরু বেচা-কেনা হবে এ হাটে। এমনকি এ হাট থেকে গরু কেনার পর সেটি জবাই এবং প্রক্রিয়া ও প্যাকেটজাত করে ক্রেতার বাসায় পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।
বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক শাহ ইমরান বলেন, শুধু ক্রেতার বাসায় নয়, বরং মাংস যাদের মধ্যে বণ্টন করা হবে ঠিকানা দিলে তাদেরও ঘরে পৌঁছে দেওয়ার মতো সেবা দেওয়া হবে। -সমকাল