হত্যা-নাশকতা-প্রতিবাদ: কোন পথে বাংলাদেশ
বাংলাদেশে সরকারবিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষিতে দেশজুড়ে ভয়ংকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে৷ হত্যা আর নাশকতা চলছে সারাদেশে৷ পরিস্থিতির দায় নিয়ে সরকারকেই সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা৷
বিশ্লেষকেরা বলছেন, ছাত্র-জনতার মনোভাব বুঝে সরকারের পদক্ষেপ নেয়া উচিত৷ যত শক্তি প্রয়োগ করা হবে তত পরিস্থিতি খারাপ হবে বলে মনে করেন তারা৷
সরকারের পদত্যাগের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একদফা আন্দোলনে অসহযোগ আন্দোলনের প্রথম দিনে ঢাকাসহ সারাদেশে ব্যাপক সহিংসতা, হত্যার ঘটনা ঘটেছে৷ গুলি করে হত্যা, পিটিয়ে হত্যা অগ্নিসংযোগসহ নানা সহিংস ঘটনা ছড়িয়ে পড়েছে৷। রোববার একদিনে নিহত ৭০ জন ছাড়িয়ে গেছে৷
পরিস্থিতি সামলাতে রোববার সন্ধ্যা থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ ঘোষণা করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়৷ নির্বাহী আদেশে সোমবার থেকে সারাদেশে তিন দিনের সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে সরকার৷
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন তাদের অসহযোগ কর্মসূচির মধ্যেই আরো নতুন কর্মসূচি দিয়েছে৷ অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম এক বিবৃতিতে এক দফা দাবিতে দুই দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন৷ সোমবার সারাদেশে যেসব এলাকায় আন্দোলনকারীরা নিহত হয়েছেন সেখানে ‘শহীদ স্মৃতিফলক উন্মোচন’ এবং একই দিন ‘লংমার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন তিনি৷
লংমার্চ টু ঢাকা কর্মসূচি মঙ্গলবারে দেয়া হয়েছিলো৷ পরে তা একদিন এগিয়ে আনা হয়৷
সোমবার সকাল ১১টায় ঢাকার শাহবাগে শ্রমিক সমাবেশ এবং বিকেল ৫টায় শহিদ মিনারে নারী সমাবেশের কর্মসূচি দেয়া হয়েছে৷ এছাড়া সারাদেশে বিক্ষোভ ও গণঅবস্থান কর্মসূচি চলবে বলে জানানো হয়েছে৷
‘লংমার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে সারাদেশের ছাত্র-নাগরিক-শ্রমিকদের ঢাকায় আসার আহ্বান জানিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন৷ ওই দিন দুপুর ২টায় ছাত্র-জনতাকে শাহবাগে জমায়েতের ডাক দেয়া হয়েছে৷
এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুপুরে নিরাপত্তাবিষয়ক জাতীয় কমিটির বৈঠক শেষে বলেছেন, ‘‘এখন যারা নাশকতা করছেন তারা ছাত্র না, সন্ত্রাসী৷ এই সন্ত্রাসীদের শক্ত হাতে দমন করার জন্য আমি দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানাই৷’’
তিনি আরো বলেন, এর যেসব জায়গায় সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, জ্বালাও-পোড়াও হয়েছে তার তদন্ত হবে৷ বলেন, ‘‘সব তদন্ত ও বিচার হোক এটা আমি চাই৷’’
হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনা হবে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘‘সহিংসতায় যেসব হত্যার ঘটনা ঘটেছে সেই হত্যা যারাই করুক, সে পুলিশ হোক, ছাত্র হোক, সে যেই হোক, সব তদন্ত হবে৷ তাদের বিচার হবে৷’’
কোন পথে দেশ
কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে ব্যাপক সহিংসতা ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে৷ তারপরও দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না৷ পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে৷
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কোটা সংস্কারসহ নয় দফা দাবি এখন এক দফায় পরিণত হয়েছে৷ তারা সরকারের পদত্যাগ চায়৷
কেন এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক ড. আব্দুর রাজ্জাক খান বলেন, ‘‘এই পরিস্থিতির জন্য সরকারই দায়ী৷ তাদের দম্ভ, ঠিক সময়ে আলোচনা না করা, শক্তি প্রয়োগ, এই সব কিছুর কারণেই এমন হয়েছে। সরকার এখনো শক্তি প্রয়োগ করছে৷ এটা আরো চললে আরো পরিস্থিতি খারাপ হবে৷ দেশে নৈরাজ্য আরো বাড়বে৷”
তিনি আরো বলেন, ‘‘এত বেশি হত্যা, এত বেশি শিশু হত্যা, এত বেশি নৃশংসতা, সহিংসতা , নাশকতা এত অল্প সময়ে বিশ্বের আর কোথাও ঘটেছে বলে আমার জানা নাই৷ এখানে তথ্য বিকৃতি করা হয়েছে৷ মিথ্যাচার করা হয়েছে৷ তাই এখন এটা আর কোটা সংস্কার দাবিতে সীমাবদ্ধ নাই৷ এখন মৌলিক অধিকার, সাধারণ মানুষের বিক্ষোভ যুক্ত হয়েছে৷ এরমধ্যে শুরু থেকেই একটি ন্যারেটিভ তৈরি করা হয়েছে৷ প্রতিপক্ষের ষড়যন্ত্রের দুর্গন্ধ খুঁজে বের করা হয়েছে৷ সেটার উপস্থিতি কতটুকু তা বিশ্লেষণ করে বের করতে হবে৷ কিন্তু সেটা যে একেবারে অনুপস্থিত তা বলা যাবে না৷ কারণ এখন তো প্রকাশ্যে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক পক্ষগুলো তাদের সঙ্গে অংশগ্রহণ করছে৷’’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘‘হত্যা হচ্ছে , নাশকতা হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় সম্পদ পোড়ানো ধ্বংস করা হচ্ছে৷ এই সব কিছুই বন্ধে সরকারকে ব্যবস্থা নিতে হবে৷ এভাবে চলতে পারে না৷ এগুলো বন্ধ করার দায়িত্ব সরকারের৷’’
সমাধান কীভাবে
ড. আব্দুর রাজ্জাক খান মনে করেন, আলোচনা ছাড়া এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসা যাবে না৷ শিক্ষার্থীরা পদত্যাগ দাবি করলেও সরকারের উচিত শক্তি প্রয়োগ না করে তাদের সঙ্গে বসা৷ তারা কেন পদত্যাগ চায় তা সরকারকে শুনতে হবে৷ তিনি বলেন, ‘‘রাজনৈতিক দলগুলো সব সময় লাশ চায়৷ তারা লাশের ওপর রাজনীতি করে৷ আমি ব্যক্তিগতভাবে চাই না ছাত্রদের আন্দোলনের ওপর ভর করে জামায়াত-শিবির ক্ষমতায় আসুক৷ কিন্তু সরকারকে তো দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে৷’’
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘‘এখন যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তাতে আর ওয়ে আউট দেখি না৷ এখন একটা ডেড এন্ডে আমরা আছি৷ সমাধানের তেমন কোনো পথ আমি দেখি না৷ এখন সরকার যদি মানুষের পালস বুঝে, তাদের ক্ষুব্ধতাকে অনুধাবন করে যদি রাষ্ট্র কাঠামোকে ঢেলে সাজানোর বাধ্যবাধকতা এবং সুযোগ এই দুইটি বিষয় নিয়ে কাজ করে তাহলে একটা সমাধান আসতে পারে৷’’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান মনে করেন, ‘‘সরকার আর এককভাবে কিছু করতে পারবে বলে মনে হয় না৷ দেশের যা পরিস্থিতি তা থেকে বের হয়ে আসতে জাতীয় সংলাপ প্রয়োজন৷ সেখান থেকে যে সমাধান আসবে সেটা মেনে নেয়া৷ সেটা সিভিল সোসাইটি ও রাজনৈতিক দলগুলো নিয়ে হতে পারে৷ তবে আমি জানি না সেটার সুযোগ এখন আর কতটা আছে৷ আর এই যে হত্যাকাণ্ড, এই যে সহিংসতা ও নাশকতা এর বিচার খুব দ্রুত করতে হবে৷’’
অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘‘ছাত্ররা সরকারের পদত্যাগ দাবি করেছে এটাকে ভিন্নভাবে দেখার কিছু নাই৷ এই দাবি তারা করছে৷ তাই বলে আলোচনা করা যাবে না সেটা তো ঠিক নয়৷ তাদের সঙ্গে সরকারকে বসতে হবে৷ আলোচনা করতে হবে৷ সমাধানের পথ বের করতে হবে৷’’