Type to search

Lead Story আন্তর্জাতিক

সিংহাসনে আরোহণ করলেন তৃতীয় চার্লস

৭০ বছর আগে রাজসিংহাসনের উত্তরাধিকারী হয়েছিলেন। ৭৪ বছর বয়সে সেই সিংহাসনে আরোহণ করলেন তৃতীয় চার্লস। এই ৭০ বছরে বিশ্বটাই যেন আমূল পালটে গেছে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কিছু বিষয় ছাড়া ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের নিয়মনীতিতেও এসেছে কিছু পরিবর্তন। রাজা চার্লসের এবারের অভিষেককে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক নতুন যুগের সূচনা বলে অভিহিত করেছেন। ব্রিটেনের রাজার এবারের অভিষেকটা কিছুটা হলেও সেই সূচনা করেছে। যদিও সিংহাসনটি ৭০০ বছরের পুরোনো।

নতুন যে বার্তা দিল রাজ অভিষেক

রাজতন্ত্রের কথা উচ্চারণ করলেই মনে হবে সামন্ততন্ত্রের ইতিহাস। কিন্তু সময় গড়িয়েছে অনেক দূর। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রাজতন্ত্রের বিভিন্ন নিময়কানুনেও এসেছে পরিবর্তন। আর এই পরিবর্তনের সূচনা করেছিলেন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। তিনি সারা জীবন জনগণের কাছে তার জনপ্রিয়তা ধরে  রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার মৃত্যুর বিভিন্ন জরিপে রাজার জনপ্রিয়তা কমলেও এখনো ব্রিটিশদের অর্ধেকের বেশি মানুষ রাজতন্ত্রকে সমর্থন করেন। তারা রাজাকে সম্মানের চোখে দেখেন।

রাজার এবারের অভিষেক জানিয়ে দিয়েছে যে, উপনিবেশিকতার শেকল থেকে বেরিয়ে এসে দুই বাহু প্রসারিত করে বৈচিত্র্যকে আলিঙ্গন করতে চায় আজকের তথা রাজা তৃতীয় চার্লসের আমলের ব্রিটেন। শনিবার রাজার অভিষেকটাই শুরু হয় ভিন্নভাবে। ভিন্নধর্মের এক মানুষের হাতে। ভারতীয় বংশোদ্ভূত হিন্দু ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক ওয়েস্ট মিনস্টারের ভিতর পবিত্র বাইবেলের একটি অংশ পড়ে অভিষেক অনুষ্ঠানের সূচনা করেন। চার্লসের অভিষেক সমাগমে ধর্মের বৈচিত্র্য যেমন ছিল, তেমনই ছিল বর্ণ ও পোশাকের বৈচিত্র্য। স্কার্ট-গাউন-বাহারি টুপি, হ্যাট-কোটের পাশে ছিল অগণিত শাড়ি, সালোয়ার, হিজাব, পাগড়ি, আলখাল্লা, পাঞ্জাবি। হিন্দু, মুসলিম, শিখ, পারসি, ইহুদি, বৌদ্ধসহ সব ধর্মের প্রতিনিধিদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছিল সামনের সারিতে। এমনকি খ্রিষ্টধর্মেরও সবরকম শাখা-প্রশাখাকে একত্র করার চেষ্টা করেছেন রাজা চার্লস। রাজপরিবার চরমভাবে প্রটেস্ট্যান্ট মতে বিশ্বাসী হলেও অর্থোডক্স, রোম্যান ক্যাথলিকসহ সব মতের পুরোহিতের হাত থেকেই রাজসিংহাসনের দায়িত্বভার বুঝে নিলেন ব্রিটিশ রাজ পরিবারের ৬২তম শাসক। শুধু তাই নয়, রাজার অভিষেক অনুষ্ঠানে প্রধান বিশপের দায়িত্বে দেখা যায় এক নারীকে। খ্রিষ্টান রাজা-রানির অভিষেকে যা এক বিরল দৃশ্য। দুই ঘণ্টার অনুষ্ঠানে বেশির ভাগ গান গেয়েছেন কৃষ্ণাঙ্গ কোয়ার গায়করা। রাজার উদ্দেশে গাওয়া স্তুতি ও ধর্মীয় সংগীতে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ছিলেন রাজার বড় নাতি ও প্রিন্স উইলিয়ামের ছেলে প্রিন্স জর্জ। অভিষিক্ত হওয়ার পর রাজা ন্যায়বিচারের শপথ নিয়ে সিংহাসনে আরোহণ করেন। বিমান বাহিনীর কসরতেও ছিল বিভিন্ন রঙের সমাহার। এর মাধ্যমে বার্তা দেওয়া হয়েছে, এই যুগে সবাই সমান। রঙের বৈষম্য নয়, রঙের বৈচিত্র্যটা এখন প্রাধান্য পাবে। বার্তা দেওয়া হয়েছে ঐক্যের।

  • রাজার সামনে যত চ্যালেঞ্জ

৭০ বছর সিংহাসনে থাকার পর রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ গত বছরের সেপ্টেম্বরে স্কটল্যান্ডের ব্যালমোরাল প্রাসাদে মারা যান। সমাজ যখন মৌলিকভাবে পরিবর্তিত হয়ে গেছে, তখন রানি এলিজাবেথ জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে তার ভূমিকা পালন করে গেছেন। তার মৃত্যুর পর রাজা তৃতীয় চার্লসের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হওয়ার মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ ইতিহাসের এক নতুন যুগের সূচনা হয়েছে। তবে এই নতুন যুগে রাজা চার্লসের সামনে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

মার্কিন গণমাধ্যম সিএনএনের সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় তথ্য উঠে এসেছে, রাজপরিবারের প্রতি মানুষের  আগ্রহ কমেছে। এ থেকে ধারণা করা হয়, রাজা তৃতীয় চার্লস তার অভিষেকের প্রাক্কালে গুরুতর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন। সমীক্ষায় অংশ নেওয়া ব্রিটেনের এক-তৃতীয়াংশ (৩৬ শতাংশ) প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিক বলেছেন, ১০ বছর আগে ব্রিটিশ রাজপরিবার সম্পর্কে যে দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, তা এখন আরো নেতিবাচক হয়েছে। তরুণ প্রজন্ম রাজতন্ত্রকে পুরোপুরি মেনে নিতে পারছে না। ছোট ভাই প্রিন্স অ্যান্ড্রুর যৌন দুর্ব্যবহারের কাহিনিও রাজার জন্য চ্যালেঞ্জের। তাকে দেখা গেছে তৃতীয় সারিতে।

রাজা চার্লসের ছোট ছেলে প্রিন্স হ্যারি রাজপরিবার ছেড়ে স্ত্রী মেগান মার্কেলকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমিয়েছেন। তাদের রাজ প্রাসাদ ছাড়ার পেছনে বর্ণবাদও এক কারণ বলে অভিযোগ রয়েছে। বাবা ও ছেলের সম্পর্ক এখন কঠিন বলে কিছু দিন হ্যারি জানিয়েছিলেন। তবে রাজা হিসেবে জাতির উদ্দেশে দেওয়া প্রথম ভাষণে চার্লস বলেন, আমি প্রিন্স হ্যারি এবং মেগানের প্রতি আমার ভালোবাসা প্রকাশ করতে চাই। কারণ তারা বিদেশে তাদের জীবন গড়ে তুলছে। এর মাধ্যমে ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক উষ্ণ করার ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের এক খবরে বলা হয়, রাজা তৃতীয় চার্লসের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো রাজতন্ত্রকে শক্তিশালী করা। তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে যে প্রতিষ্ঠানটি পেয়েছেন প্রকৃতিগতভাবে সেটি অগণতান্ত্রিক, টিকে থাকার জন্য জনসমর্থন প্রয়োজন। ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের অধ্যাপক এবং ব্রিটেনের সংবিধান বিশেষজ্ঞ রবার্ট হ্যাজেল বলেন, ব্রিটিশ রাজতন্ত্র একটি প্রতিষ্ঠান যা শুধু জনগণের সমর্থনে টিকে থাকতে পারে।

এই অভিষেকে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে। এ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। কারণ এই টাকা জনগণের করের টাকা। বেশির ভাগই ব্রিটিশ সরকার বহন করে। ফলে এ যুগেও রাজতন্ত্রের প্রয়োজন আছে কি না, তা নিয়েও অনেকে প্রশ্ন তুলছেন। যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের ১৪টি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান হয়েছেন রাজা চার্লস। এর কয়েকটি দেশ কমনওয়েলথে থাকার পাশাপাশি পুরোপুরি প্রজাতান্ত্রিক হতে চায়। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুর পরপরই এ দেশগুলোতে রাজা চার্লসকে তাদের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে মেনে নেওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন ওঠে। কাজেই রাজতন্ত্র টিকিয়ে রাখার কাজটি রাজা চার্লসের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।

এবিসিবি/এমআই

Translate »