Type to search

Lead Story অপরাধ জাতীয় মিডিয়া সম্পাদকীয় ও মতামত

সাংবাদিক গ্রেফতার নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নতুন দাবির কারণ কী

‘মিথ্যা ও রাষ্ট্রবিরোধী’ প্রতিবেদনের মামলায় প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানকে ছয় সপ্তাহের আগাম জামিন দিয়েছে হাইকোর্ট, তবে ওই একই অভিযোগে পত্রিকাটির এক সাংবাদিককে গ্রেফতারের পেছনে এখন ভিন্ন এক কারণের কথা বলছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

বুধবার মধ্যরাতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ঢাকার রমনা থানায় দায়ের করা যে মামলায় মি. রহমান আজ জামিন পেয়েছেন, তাতে তার বিরুদ্ধে ‘মিথ্যা ও রাষ্ট্রবিরোধী প্রতিবেদন’ প্রকাশের অভিযোগ আনা হয়।

এ মামলায় পত্রিকাটির সাংবাদিক শামসুজ্জামান শামস ও একজন অজ্ঞাত ক্যামেরাম্যানকেও আসামী করা হয়েছে। এর আগে তেজগাঁও থানায় করা একই ধরনের আরেকটি মামলায় শামসুজ্জামানকে আসামী করার পর বুধবার ভোরে তাকে সিআইডি পরিচয়দানকারী ব্যক্তিরা বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায় । এর ত্রিশ ঘণ্টা পরে তাকে আদালতে তোলার পর রমনা থানার করা মামলায় কারাগারে পাঠানো হয়।

তবে শনিবার ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে দাবি করেছে যে শামসুজ্জামান শামসকে গ্রেফতার করা হয়েছে ‘শিশু নির্যাতন ও শিশুর অপব্যবহারের’ কারণে, – দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করার জন্য নয়।

এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে এ পর্যন্ত যে দুটি মামলা হয়েছে তাতে শিশু নির্যাতনের অভিযোগ ছিল না।

কিন্তু ঘটনার সাত দিন পর এসে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কেন এমন অভিযোগ আনলো – তার কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি।

একজন সাবেক কূটনীতিক বিবিসি বাংলাকে বলেছেন যে তার ধারণা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হয়েছে সেটি কমানোর জন্যই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই ‘শিশু ইস্যুটি’ এনে থাকতে পারে।

 
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় কারাগারে আছেন প্রথম আলোর সাংবাদিক শামসুজ্জামান শামস।
ছবির ক্যাপশান,ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় কারাগারে আছেন প্রথম আলোর সাংবাদিক শামসুজ্জামান শামস।

মতিউর রহমানের আগাম জামিন

রবিবার প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানের পক্ষ থেকে তার আইনজীবীরা জামিন আবেদন করলে বিকেলে শুনানি শেষে ছয় সপ্তাহের জামিন মঞ্জুর করে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ।

শুনানির সময় প্রথম আলো সম্পাদক আদালতে উপস্থিত ছিলেন।

মিস্টার রহমানের আইনজীবীদের একজন প্রশান্ত কর্মকার বিবিসি বাংলাকে এ তথ্য জানিয়েছেন।

গত ২৯শে মার্চ মধ্যরাতে আব্দুল মালেক মশিউর মালেক নামের একজন আইনজীবী রমনা থানায় এ মামলাটি দায়ের করেছিলেন। ওই মামলায় প্রথম আলোর সাংবাদিক শামসুজ্জামান শামস এবং অজ্ঞাত একজন ক্যামেরাম্যানকেও আসামি করা হয়।

শামসুজ্জামান শামসকে ওই রাতেই তার বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় সিআইডি পরিচয় দিয়ে এবং এর ত্রিশ ঘণ্টা পর তাকে আদালতে উপস্থাপন করা হয়।

তিনি এখন কারাগারে আছেন।

এর মধ্যে যুবলীগের একজন নেতা গোলাম কিবরিয়াও তেজগাঁও থানায় আরেকটি মামলা করেছিলেন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে।

‘প্রথম আলো’র যে ছবি ও উদ্ধৃতি নিয়ে বিতর্কের শুরু

প্রসঙ্গত, গত ২৬শে মার্চ দৈনিক প্রথম আলোয় প্রকাশিত একটি সংবাদে একজন দিনমজুরের বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছিল, যেখানে উদ্ধৃতি দেয়া হয়, ‘’পেটে ভাত না জুটলে স্বাধীনতা দিয়া কী করুম। বাজারে গেলে ঘাম ছুটে যায়। আমাগো মাছ, মাংস আর চাইলের স্বাধীনতা লাগব’’।

সেই সংবাদের সঙ্গে একটি শিশুর ছবি ছিল, যে গ্রিলের ফাঁক দিয়ে স্মৃতিসৌধের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

এ নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে আলোচনা শুরু হলে পরবর্তীতে প্রথম আলো ওই খবরটি সংশোধন করে আবার প্রকাশ করে।

প্রথম আলোর পক্ষ থেকে একটি বিবৃতিতে বলা হয়, প্রথমে প্রকাশিত এই প্রতিবেদনের শিরোনাম এবং ব্যবহার করা ছবির মধ্যে অসঙ্গতি থাকায় ছবিটি তুলে নেয়া হয়েছে এবং শিরোনাম সংশোধন করা হয়েছে। পত্রিকাটি জানিয়েছে তারা প্রতিবেদনে কোথাও বলেনি যে উক্তিটি শিশুর বরং স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে যে উক্তিটি দিনমজুর জাকির হোসেনের।

কিন্তু এর মধ্যেই প্রথম আলোর এ রিপোর্টকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ সরকারী দলের নেতা ও মন্ত্রীরা পত্রিকাটির তুমুল সমালোচনা করে এর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলেছেন।

শনিবার এক অনুষ্ঠানে মিস্টার কাদের বলেছেন, প্রথম আলো পত্রিকা নানাভাবে সরকারকে ‘হেয়’ করার চেষ্টা করছে।

তিনি বলেছিলেন “প্রথম আলো আর বিএনপি সাপ্লিমেন্ট করে একজন আরেকজনকে। টার্গেট হচ্ছে সরকার, টার্গেট শেখ হাসিনা, টার্গেট গণতন্ত্র, টার্গেট আগামী নির্বাচন ভণ্ডুল করা।”

রোববার আরেক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন প্রথম আলো যা করেছে সেটি তার ভাষায় ভুল নয় বরং অমার্জনীয় অপরাধ করেছে।

মামলার অনুলিপি।
ছবির ক্যাপশান,রমনা থানার মামলায় আসামী করা হয়েছিলো প্রথম আলো সম্পাদককেও।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দাবি ‘শিশু নির্যাতন’

প্রথম আলোর সংবাদকে কেন্দ্র করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে যে দুটি মামলা হয়েছে তাতে সাংবাদিক গ্রেফতার ও সম্পাদককে আসামি করার পর দেশে বিদেশে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।

বিশ্বজুড়ে গণমাধ্যম নিয়ে কাজ করার প্রতিষ্ঠানগুলো এর তীব্র সমালোচনা করে এসব মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে। উদ্বেগ জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিশ্বের নানা দেশ ও মানবাধিকার সংস্থা।

এর মধ্যেই শনিবার এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায় যে প্রথম আলো সাংবাদিককে গ্রেফতার করা হয়েছে শিশু নির্যাতন ও শিশুর অপব্যবহারের কারণে, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করার জন্য নয়।

সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সরকারের নজরে এসেছে যে, কিছু আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ও প্রতিষ্ঠান দাবি করছে- ‘বাংলাদেশে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়া’ নিয়ে লেখার কারণে সাংবাদিক শামসুজ্জামানকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এই তথ্য সম্পূর্ণ মিথ্যা ও অতিরঞ্জিত। এই সাংবাদিককে গ্রেফতার করা হয়েছে ‘শিশু নির্যাতন’ ও ‘শিশুর অপব্যবহারের’ কারণে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সব নাগরিক ও সংবাদমাধ্যমের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষায় সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ উল্লেখ করে বলছে, প্রতারণামূলক কাজের মাধ্যমে সামাজিক অস্থিরতা তৈরি করা সৎ সাংবাদিকতার মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

“জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদের পক্ষভুক্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সরকার এ ধরনের শিশু নির্যাতনের কাজ সহ্য করবে না। পাশাপাশি মহান স্বাধীনতাকে কলঙ্কিত করার এমন চেষ্টাকেও গ্রহণ করবে না সরকার”।

তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কেন নতুন করে এ অভিযোগ সামনে আনলো – তার কোনো ব্যাখ্যা মন্ত্রণালয় দেয়নি।

যদিও বিশ্লেষকরা মনে করছেন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে যেভাবে খবরটি এসেছে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে সেটিকে সামনে রেখেই ‘শিশু নির্যাতন’ ইস্যুটিকে সামনে আনার চেষ্টা করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে সাবেক একজন কূটনীতিক বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, আন্তর্জাতিক মহলে নেগেটিভ রিঅ্যাকশন কমিয়ে আনার জন্যই শিশু ইস্যুকে সামনে এনে বিবৃতি দিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

“ব্যাপারটা অনেক শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো। কিন্তু প্রকৃত তথ্য ঢাকায় মিশনগুলোর মাধ্যমে আগেই সবাই জেনেছে। আর মামলায় যা বলা হয়টি সেটি মন্ত্রণালয় এভাবে এনে সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতাকে আরও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

প্রথম আলোর সাংবাদিক শামসুজ্জামান শামসের মুক্তি চেয়ে বিক্ষোভ

ছবির উৎস,GETTY IMAGES

ছবির ক্যাপশান,প্রথম আলোর সাংবাদিক শামসুজ্জামান শামসের মুক্তি চেয়ে বিক্ষোভ

মামলায় যা আছে

মামলার এজাহারে আব্দুল মালেক মশিউল মালেক বলেছেন ২৬শে মার্চ রাত নয়টার দিকে তিনি তার মোবাইলে একটি প্রতিবেদনের স্ক্রিনশট দেখতে পান। যার শিরোনাম ছিলো “পেটে ভাত না জুটলে স্বাধীনতা দিয়া কী করমু। বাজারে গেলে ঘাম ছুটে যায়। আমাগো মাছ, মাংস আর চাইলের স্বাধীনতা লাগবো”।

মিস্টার মালেক বলেন, প্রথম আলোর প্রতিবেদক ‘জাকির হোসেন নামে একটি দিনমজুর শিশুর জবানী’ উল্লেখ করে নিউজ করেছেন।

এরপর ২৭শে মার্চ একাত্তর টিভি নামক একটি টেলিভিশনে তিনি একটি প্রতিবেদন দেখেন। ওই প্রতিবেদনে তিনি দেখতে পান যে ওই শিশুর নাম জাকির নয়। তার নাম সবুজ। ওই শিশু ওই টিভিকে জানায় যে স্বাধীনতা দিবসের দিন একজন লোক প্রথম আলোর সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে তাকে দশ টাকা দিয়ে তার সামনে মাইক্রোফোন ধরে ও ক্যামেরায় ছবি তোলে।

একাত্তর টিভির প্রতিবেদন দেখে মশিউর মালেক আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েন বলে এজাহারে উল্লেখ করেন এবং তার ১৯৭৪ সালে বাসন্তীর জাল পরানো ছবির কথা মনে পড়ে যায়। (এটি বাংলাদেশের একটি ব্যাপক আলোচিত ঘটনা। ১৯৭৪ সালে ইত্তেফাক পত্রিকায় ছবিটি প্রকাশিত হয়েছিলো।)

মিস্টার মালেক এজাহারে আরও বলেন স্বাধীনতা দিবসের দিনে ‘প্রথম আলো একটি মিথ্যা ও রাষ্ট্র বিরোধী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে’।

এ কারণে জনমনে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে ও দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে আইন শৃঙ্খলার অবনতির উপক্রম হয়েছে বলেও মামলায় অভিযোগ করেন তিনি।

বিবিসি বাংলা

Translate »