শির সৌদি আরব সফর: আমেরিকার জায়গা নেবে চীন?
চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং সাত বছর পর সৌদি আরব সফরে গেলে তাকে নিয়ে আরব বিশ্বের নেতাদের মধ্যে যে মাত্রার আগ্রহ-উচ্ছ্বাস দেখা গেছে তার নজির বিরল। সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং কাতারসহ উপসাগরীয় সহযোগিতা জোটের (জিসিসি) সবগুলো দেশের নেতা প্রেসিডেন্ট শির সঙ্গে বৈঠকের জন্য রিয়াদে আসেন। পরে গত শুক্রবার চীন-আরব শীর্ষ বৈঠকে যোগ দিতে রিয়াদে হাজির হন মিশর, তিউনিসিয়া, লেবানন, ইরাক এবং সুদানের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ। আরব বিশ্বের নৈকট্যের জন্য চীনারাও তাদের আগ্রহ-আকাঙ্ক্ষা প্রকাশে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করেনি।
প্রেসিডেন্ট শির সফরের ঠিক আগে চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র এক বিবৃতি জারি করে বলেন, চীন রাষ্ট্র সৃষ্টির পর এই প্রথম আরব বিশ্বের সঙ্গে তারা এতটা ঘনিষ্ঠ হচ্ছে। এই সফর চীন এবং আরব বিশ্বের সম্পর্কে মাইলফলক হয়ে থাকবে। ইতিহাস তৈরি হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট শির একটি লেখা বিভিন্ন সৌদি দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছে। যেখানে তিনি বলেন, আরব বিশ্বের সঙ্গে চীনের সম্পর্কের ইতিহাস ২ হাজার বছরের পুরোনো।
ইসলামের নবির (স.) একটি উদ্ধৃতি উল্লেখ করেন চীনা প্রেসিডেন্ট, যেখানে নবি (স.) তার অনুসারীদের জ্ঞানার্জনের জন্য দরকার হলে চীনে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। সৌদি মিডিয়ার মতে, বুধবার দুই দেশের মধ্যে নানা ক্ষেত্রে ৩ হাজার কোটি ডলার মূল্যের ৩৪টি চুক্তি এবং সমঝোতা চুক্তি হয়েছে। প্রেসিডেন্ট শির এই সফর এবং তাকে নিয়ে সৌদি আরবসহ আরব নেতাদের এই মাতামাতি আমেরিকার যে একবারেই পছন্দ হয়নি তাতে সন্দেহ নেই।
কারণ জ্বালানি সম্পদে সমৃদ্ধ উপসাগরীয় আরব অঞ্চলকে আমেরিকা বহুদিন ধরে তাদের প্রভাব বলয়ের অন্যতম মূল কেন্দ্র হিসেবে বিবেচনা করে, এবং যে দেশের নেতাকে নিয়ে সেখানে এত উদ্দীপনা সেই চীন বর্তমান বিশ্বে আমেরিকার এক নম্বর কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বী। লন্ডনে মধ্যপ্রাচ্য রাজনীতির বিশ্লেষক সামি হামদি বলেন, সৌদি আরব এ বছরের শুরুর দিকেই চীনা প্রেসিডেন্টকে আমন্ত্রণের সিদ্ধান্ত নেয়, কিন্তু ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকে বার বার রিয়াদের কাছে এ নিয়ে আপত্তি জানানো হয়। সে সময় সৌদি মিডিয়ায় চীনা নেতাকে আমন্ত্রণ জানানোর সিদ্ধান্তের কথা ছাপাও হয়েছিল, কিন্তু পরে তা পরে চাপা পড়ে যায়। কিছু দিন অপেক্ষা করলেও সৌদি আরব শেষ পর্যন্ত আমেরিকার উদ্বেগ অগ্রাহ্য করল। শুধু চীনা প্রেসিডেন্টকে আমন্ত্রণই নয়, জুলাইতে প্রেসিডেন্ট বাইডেন জেদ্দায় গিয়ে তেলের উৎপাদন বাড়ানোর অনুরোধ করলেও ক্ষমতাধর সৌদি যুবরাজ মোহামেদ বিন সালমান সে বিষয়ে গুরুত্ব দেননি।
কেন সৌদিদের সঙ্গে আমেরিকার এই দূরত্ব : অনেক বিশ্লেষক মনে করেন বেশ কিছু দিন ধরেই মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে, বিশেষ করে সৌদি আরব বা আমিরাতের মধ্যে নিরাপত্তা, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্কের জন্য আমেরিকার ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর তাগিদ দেখা যাচ্ছে। ২০১৭ সালে সৌদি আরবের ক্ষমতা হাতে পাবার পর যুবরাজ সালমান আধুনিক এবং স্বাবলম্বী একটি দেশে পরিণত করতে উঠেপড়ে লেগেছেন।
এজন্য গুপ্তচরবৃত্তিতে সংশ্লিষ্টতার যুক্তিতে চীনা যে টেলিকম কোম্পানিকে যুক্তরাষ্ট্র নিষিদ্ধ করেছে, সেই হুয়াওয়ে সৌদি আরব এবং ইউএই-সহ বেশ কয়েকটি উপসাগরীয় দেশে ফাইভ-জি নেটওয়ার্ক বসিয়েছে। স্পর্শকাতর তথ্য চুরির ঝুঁকি নিয়ে আমেরিকার কথা এসব দেশ কান দেয়নি। এমনকি বুধবার সৌদি আরব ও চীনের মধ্যে যেসব চুক্তি হয়েছে তার মধ্যে একটি চুক্তির আওতায় হুয়াওয়ে সৌদি আরবে বেশ কতগুলো ডেটা সেন্টার প্রতিষ্ঠিত করবে। যেখানে ক্লাউডে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ডেটা সংরক্ষিত থাকবে। তবে আমেরিকার সঙ্গে সৌদি প্রশাসনের সম্পর্ক শীতল হওয়ার পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ সাংবাদিক জামাল খাশোগির হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে যুবরাজ সালমানের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সম্পর্কের টানাপড়েন ।
ঐ হত্যাকাণ্ডের জন্য প্রেসিডেন্ট বাইডেন তার নির্বাচনি প্রচারণার সময় থেকেই খোলাখুলি যুবরাজ সালমানকে দায়ী করে অনেক বক্তব্য দিয়েছেন। তাকে একঘরে করে ফেলার হুমকি দিয়েছেন। খাশোগি হত্যাকাণ্ডের জন্য যেন যুবরাজ সালমানকে কখনো যুক্তরাষ্ট্রে মামলায় না পড়তে হয় তার নিশ্চয়তা চেয়ে সৌদি রাজপ্রাসাদের পক্ষ থেকে হোয়াইট হাউজের কাছে অনুরোধ করা হলেও এখনো কোনো নিশ্চয়তা বাইডেন দেননি। যুবরাজ সালমান অপমানিত বোধ করেছেন। শি জিনপিংকে নিয়ে তিনি যে মাতামাতি করলেন তার পেছনে আমেরিকাকে দেখানোর বিষয়টিও রয়েছে বলে আমি নিশ্চিত, বলেন সাদি হামদি। জো বাইডেন যখন জেদ্দায় আসেন তাদের দুজনের মধ্যে করমর্দন পর্যন্ত হয়নি। এখন মোহামেদ সালমান চীনা প্রেসিডেন্টকে আমন্ত্রণ করে নিয়ে এসে আমেরিকানদের দেখাতে চেয়েছেন, তিনি নতুন এক আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পথ নিয়েছেন। শুধু তিনি নিজে নয়, অন্য আরব নেতাদেরও তিনি এই পথে আনছেন।
ক্ষয়িষ্ণু সুপার-পাওয়ার : তবে এটা অনস্বীকার্য যে, আরব বিশ্বে বেশ কিছু দিন ধরেই একটা ধারণা দিন দিন জোরালো হচ্ছে যে, মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে আমেরিকার আগ্রহ কমছে এবং সুপার-পাওয়ার হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যাচ্ছে। আরব বিশ্বে এমন কথা এখন খোলাখুলি উচ্চারিত হচ্ছে যে, তাদের এখন শুধু আমেরিকার দিকে না তাকিয়ে বহুমুখী সম্পর্কের পথ নিতে হবে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্টের কূটনৈতিক উপদেষ্টা আনোয়ার গারগাহ সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে ভাষণে বলেন, ‘বিশ্ব ব্যবস্থায় আমেরিকার একচ্ছত্র আধিপত্য আর থাকবে বলে আমার মনে হয় না। … চীন এখন অর্থনীতিতে প্রধান একটি দেশ, তারা এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি রাজনৈতিক শক্তি। উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে, বিশেষ করে সৌদিদের সঙ্গে চীনের বাণিজ্য এবং বিনিয়োগ সম্পর্ক লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। সৌদি আরব এবং চীনের মধ্যে ২০২১ সালে ব্যবসা হয়েছে ৮ হাজার কোটি ডলারের। এ বছর তা আরো অনেক বেশি হবে। সৌদি আরব এখন চীনের জ্বালানি তেলের প্রধান জোগানদার।
আমেরিকার চিন্তা : উন্নয়ন ও প্রযুক্তির জন্য চীনসহ অন্যান্য দেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক করতে উপসাগরীয় দেশগুলোর আগ্রহের বাস্তবতা অনেকটাই মেনে নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, কিন্তু অনেক বিশ্লেষক বলছেন, কৌশলগত নিরাপত্তার ক্ষেত্রে চীনের সম্পৃক্ত হয়ে পড়া নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন। উপসাগরীয় দেশগুলাতে হুয়াওয়ে টেলিকম নিয়ে আমেরিকানরা চিন্তিত। চীন এখন সৌদিদের সামরিক ড্রোন তৈরিতে সাহায্য করছে। এমনকি বছরখানেক আগে সিএনএন রিপোর্ট করেছিল, চীন সৌদি আরবকে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র উত্পাদনে সাহায্য করছে। শুক্রবার রিয়াদে আরব নেতাদের সঙ্গে শীর্ষ বৈঠকে চীনা প্রেসিডেন্ট পারমাণবিক জ্বালানি এবং মহাকাশ প্রযুক্তিতে সহযোগিতার প্রস্তাব দিয়েছেন।
সৌদি-চীন সম্পর্কের যে বিষয়টি আমেরিকার জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ—তা হলো সৌদিরা মনে করে চীনের সঙ্গে কাজ করা তাদের জন্য সহজ। আলজাজিরা অনলাইনের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, গবেষণা সংস্থা আটলান্টিক কাউন্সিলের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক কর্মসূচির গবেষক জনাথন পিকফোর্ড। সৌদিরা মনে করে, রাজনীতি নিয়ে চীন মাথা ঘামাবে না। মানবাধিকারের বিষয়ে ‘লেকচার’ দেবে না যেটা নিয়ে পশ্চিমাদের অনেক ‘মাথাব্যথা’। অস্ত্র কোথায় ব্যবহার হবে তা নিয়ে শর্ত আরোপ করবে না। আমেরিকার ভয় এসব কারণে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো চীনের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সহযোগিতার সম্পর্কে জড়িয়ে পড়বে।
আমেরিকার জায়গা নেবে চীন? : তবে অধিকাংশ পর্যবেক্ষক মনে করেন, আরব বিশ্বে চীনের পক্ষে এখনো বহুদিন আমেরিকার বিকল্প হয়ে ওঠা সম্ভব হবে না। এর প্রধান কারণ, অস্থির এই অঞ্চলে নিরাপত্তার জন্য উপসাগরীয় দেশগুলোর কাছে আমেরিকা ছাড়া কোনো গতি নেই। মধ্যপ্রাচ্যের বাস্তবতা যদি আপনি দেখেন, তাহলে বুঝবেন আমেরিকার প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ করা সম্ভব নয়। পুরো অঞ্চল জুড়ে কতগুলো এবং কোথায় আমেরিকানদের ঘাঁটি রয়েছে তা দেখলেই আপনি বুঝবেন। এ অঞ্চলের যে কোনো বিরোধের মধ্যস্থতায় আমেরিকার প্রভাব সবচেয়ে বেশি। চীন এখনো এর ধারেকাছেও নেই, বলেন সাদি হামদি। তার মতে, সৌদি আরব কতটা চীনের ওপর নির্ভরশীল হতে প্রস্তুত, কতটা আমেরিকার প্রভাবমুক্ত হওয়ার জন্য প্রত্যয়ী তা নিশ্চিত হতে আরো অপেক্ষা করতে হবে।
এবিসিবি/এমআই