লোকারণ্য শহীদ মিনার থেকে সরকার পদত্যাগের এক দফা ঘোষণা, কুমিল্লায় গুলিবিদ্ধ ১০ জন
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে শিক্ষার্থী হত্যার বিচারের দাবিতে এবং গ্রেফতারের প্রতিবাদে শনিবার ঢাকার বিশাল এক সমাবেশ থেকে বর্তমান সরকারের পদত্যাগের দাবিতে এক দফা ঘোষণা করা হয়েছে। সেই সঙ্গে সবার নিকট গ্রহণযোগ্য ব্যক্তির নেতৃত্বে একটি গ্রহণযোগ্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক জাতীয় সরকার গঠনের দাবি জানানো হয়েছে।
অন্যদিকে জেলায় জেলায় গণমিছিল কর্মসূচির অংশ হিসেবে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা ঢাকা ছাড়াও চট্টগ্রাম, রংপুর, সিলেট, রাজশাহীসহ অনেক শহরে বিশাল সমাবেশ করেছে। এই কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে কুমিল্লা, সিলেট, বগুড়া ও গাজীপুরে সংঘর্ষের খবর পাওয়া গেছে।
এছাড়া বরিশালে মহাসড়ক অবরোধ ছাড়াও পুলিশ বক্স ভাংচুরের ঘটনা ঘটেছে। রাজশাহীতেও তিনটি পুলিশ বক্সে আগুন দেয়ার খবর পাওয়া গেছে। কয়েকটি জেলায় আন্দোলনকারী ও পুলিশের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
আগের ঘোষণা অনুযায়ী রোববার থেকে আন্দোলনকারীদের ‘সর্বাত্মক অসহযোগ’ কর্মসূচি পালনের কথা রয়েছে।
ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সমাবেশে আন্দোলনকারীদের একজন সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, “এ সরকার কোনভাবেই আর এক মিনিট ক্ষমতায় থাকার অধিকার নেই। শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করলেই হবে না, বরং খুন, লুটপাট, দুর্নীতি এদেশে হয়েছে তার বিচার হতে হবে। আমরা পদত্যাগ দিয়ে তাকে এক্সিট রুট দিতে চাই না। তাকে পদত্যাগও করতে হবে, বিচারের আওতায়ও আনতে হবে”।
এর আগে আন্দোলনকারীদের সাথে শনিবারই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আলোচনার আগ্রহ প্রকাশ করলেও তারা তা প্রত্যাখ্যান করেছে।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন “আন্দোলন চলে গেছে তৃতীয় পক্ষের হাতে, যারা বাংলাদেশকে অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করতে দেশকে খাদের কিনারায় নিয়ে যেতে চায়। এই অশুভ শক্তির অশুভ তৎপরতা আমরা সফল হতে দিতে পারি না”।
অন্যদিকে বিরোধী দল বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগী বলেছেন কোটা বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে এসে গেছে এবং ছাত্র-শিক্ষার্থীদের বিজয় অবশ্যই হবে। “দেশে একটা গণজাগরণ শুরু হয়ে গেছে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সাধারণ মানুষ যোগ দিয়েছেন। সব পেশার মানুষ, সব ধরনের মানুষ এই আন্দোলনে যুক্ত হয়েছে”।
শহীদ মিনার ও ক্যাম্পাস লোকে লোকারণ্য
ঢাকায় কেন্দ্রীয় কর্মসূচি হিসেবে মিছিল নিয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমবেত হয় হাজার হাজার বিক্ষোভকারী। সেখানে মূহুর্মূহু সরকার বিরোধী শ্লোগানে আটক শিক্ষার্থীদের মুক্তির দাবি এবং সরকারের পদত্যাগের দাবি জানায় আন্দোলনকারীরা।
দুপুর থেকেই নগরীর বিভিন্ন দিক থেকে আন্দোলনকারীরা মিছিল নিয়ে শহীদ মিনারের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এছাড়া শিল্পীদের একটি গ্রুপসহ বিভিন্ন প্লাটফরম থেকেও বেশ কিছু ছোট ছোট মিছিল এসে আন্দোলনকারীদের সাথে যোগ দিয়ে তাদের সংহতি প্রকাশ করেছে।
শিক্ষার্থীদের অনেকের অভিভাবকও সেখানে জমায়েত হয়েছেন। আজিমপুর এলাকা থেকে সপরিবারে আসা এক অভিভাবক বিবিসি বাংলাকে বলেন তার এক সন্তান কয়েকদিন ধরেই বিক্ষোভ সমাবেশে অংশ নিচ্ছে।
“আমরাও দুদিন ধরে আসছি এসব কর্মসূচিতে। ছাত্র হত্যার প্রতিবাদ করতে আমরা এখানে এসেছি,” বলছিলেন তিনি। শহীদ মিনারের বিভিন্ন দিক দিকে একের পর এক মিছিল আসায় পুরো এলাকা বিক্ষোভকারীদের উপস্থিতিতে পূর্ণ হয়ে গেছে। রিকশা চালকদের একটি দলও সেখানে গিয়ে সংহতি জানিয়েছে।
এর আগে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় সড়ক ও মোড়ে জমায়েত হয়ে সেখান থেকে মিছিল নিয়ে শহীদ মিনারের দিকে এগিয়ে যায় মিছিলকারীরা।
আর সমাবেশের শেষ পর্যায়ে নয় দফার বদলে সমন্বয়কদের দিক থেকে সরকার পতনের এক দফার ঘোষণা দিলে আন্দোলনকারীরা শ্লোগানে উত্তাল হয়ে পড়ে।
পরে শিক্ষার্থীদের একটি অংশ টিএসসি ও শাহবাগ এলাকায় ও আরেকটি অংশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান করে সরকার বিরোধী শ্লোগান দিতে থাকে।
চট্টগ্রামেও বিশাল জমায়েত
চট্টগ্রামের সাংবাদিক কমল দাশ জানিয়েছেন হাজার হাজার বিক্ষোভকারী বিভিন্ন এলাকা থেকে মিছিল নিয়ে এসে সেখানকার নিউমার্কেট এলাকায় সমবেত হয়েছিলো।
সরকার বিরোধী নানা ধরনের ব্যানার, প্লাকার্ড ও ফেস্টুন নিয়ে শ্লোগান দিতে দিতে তারা সমাবেশস্থলে জমায়েত হয়। এসময় তারা আটক শিক্ষার্থীদের মুক্তি ও সরকারের পদত্যাগের দাবি জানায়।
সমাবেশ শেষ হলে বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে তিনটি মিছিলে ভাগ হয়ে তিন দিকে চলে যায়। এ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সেখানে কোন অপ্রীতিকর ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি।
সিলেটে, কুমিল্লা ও বগুড়ায় সংঘর্ষ
আন্দোলনকারীদের ঘোষিত মিছিল ও সমাবেশের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সিলেটে সংঘর্ষের খবর পাওয়া গেছে। সংঘর্ষের সময় পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ারশেল ব্যবহার করেছে।
শহরের চৌহাট্টায় বিকেল পাঁচটার দিকে উভয় পক্ষের মধ্যে ইট-পাটকেল বিনিময়ের পর সেখানে সংঘর্ষ বেধে যায় বলে জানিয়েছেন স্থানীয় সংবাদকর্মীরা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ শটগানের গুলি ছুঁড়েছে।
পরে এক পর্যায়ে বিক্ষোভকারীরা নয়াসড়ক, জিন্দাবাজার ও দরগাহ এলাকার দিকে ভাগ হয়ে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। সংঘর্ষের জন্য পুলিশ ও আন্দোলনকারীরা পরস্পরকে দায়ী করেছে।
এর আগে দুপুর একটার দিক থেকেই চৌহাট্টায় সমবেত হতে শুরু করে আন্দোলনকারীরা। এসময় তাদের সরকার বিরোধী বিভিন্ন শ্লোগান দিতে দেখা গেছে।
ওদিকে কুমিল্লা থেকে স্থানীয় সাংবাদিক মাসুক আলতাফ চৌধুরী জানান, প্রায় হাজার খানেক শিক্ষার্থী কর্মসূচিতে যোগ দিতে জিলা স্কুলের সামনে জড়ো হয়। এরপর নয় দফা দাবিতে শিক্ষার্থীরা সেখান থেকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে ফৌজদারি হয়ে পুলিশ লাইনসের দিকে এগোতে থাকে।
এসময় সেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অবস্থান থাকলেও তাদের পক্ষ থেকে কোনো বাধা দেয়া হয়নি। কিন্তু মিছিল নিয়ে শিক্ষার্থীরা রেসকোর্স এলাকায় পৌঁছালে তাদের ওপর হামলা করে যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা–কর্মীরা।
এসময় শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে ছররা গুলিও ছোঁড়ে তারা। এতে অন্তত ১০ জন গুলিবিদ্ধ হবার খবর পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে গুলিবিদ্ধ পাঁচ শিক্ষার্থীকে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান আন্দোলনকারীরা।
তবে স্থানীয় আওয়ামী লীগ হামলার অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
এছাড়া বগুড়ায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের দফায় দফায় সংঘর্ষ ও ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। শহরের সার্কিট হাউজ মোড় ও কালীবাড়ী মোড়সহ কয়েকটি এলাকায় সংঘর্ষ হয়েছে।
এর আগে বিক্ষোভকারীরা মিছিল নিয়ে সাতমাথা এলাকায় অবস্থান নিলে ওই এলাকা প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। পরে পুলিশ ও বিক্ষোভকারীদের মধ্যে উত্তেজনা শুরু হলে এক পর্যায়ে পুলিশ টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে এবং বিক্ষোভকারীদের একাংশ পুলিশ প্লাজার সামনে পুলিশের সাজোয়া যানে হামলা করে।
এক পর্যায়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সাউন্ড গ্রেনেড ও রাবার বুলেটও ছুড়তে দেখা গেছে পুলিশকে।
দুই পুলিশ সাময়িক বরখাস্ত
রংপুরে কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদের মৃত্যুর ঘটনায় দুই পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
এ দুজন হলেন—রংপুর পুলিশ লাইনের এএসআই আমির হোসেন ও তাজহাট থানার কনস্টেবল সুজন চন্দ্র রায়।
শনিবার দুপুরে ওই দুজনকে সাময়িক বরখাস্তের তথ্য নিশ্চিত করেছেন রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মো. মনিরুজ্জামান।
দুই পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্তের কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, তারা ‘অপেশাদারি আচরণস্বরূপ’ শটগান থেকে ফায়ার করেন।
গত ষোলই জুলাই রংপুরে কোটা সংস্কার আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নিহত হন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। বৈষম্যবিরোধী কোটা সংস্কার আন্দোলনে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম সমন্বয়ক ছিলেন আবু সাঈদ।
বিবিসি