র্যাবকে নিষেধাজ্ঞার চিঠিটা সম্ভবত কেউ টাকা দিয়ে করিয়েছে

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং গুমের অভিযোগে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) কাছে ইভান স্টেফানেক নামে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের এক সদস্য যে চিঠি দিয়েছেন, তা কেউ অর্থের বিনিময়ে করিয়ে থাকতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন।
তিনি বলেন, ‘এই চিঠির তথ্যের সঙ্গে বাংলাদেশের বাস্তবতার মিল নেই, সম্ভবত কেউ টাকা পয়সা দিয়েছে, না পড়েই সই করে দিয়েছেন।’
কূটনৈতিক সূত্রে জানা যায়, গত ২০ জানুয়ারি স্লোভাকিয়ার ইউরোপীয় পার্লামেন্ট সদস্য ইভান স্টেফানেক বাংলাদেশ প্রসঙ্গে ইইউর পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা নীতিমালাবিষয়ক জ্যেষ্ঠ প্রতিনিধি এবং ইউরোপীয় কমিশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট জোসেপ বোরেলের কাছে একটি চিঠি লিখেন। ওই চিঠিতে তিনি র্যাবের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার প্রসঙ্গটি উল্লেখ করেন।
স্টেফানেকের চিঠির বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, ‘চিঠিটি ভাল করে পড়ে দেখুন, এই চিঠি পড়লে মনে হয় বাংলাদেশে কেউ বাস করতে পারছে না, এখানে কারও বাস করার মত পরিস্থিতি নেই! কিন্তু এটা বাংলাদেশের বাস্তবতা নয়। বাংলাদেশে মানুষ খুব ভালভাবেই জীবন যাপন করছে, জীবন যাত্রার মান দিন দিন উন্নত হচ্ছে। অতএব ইউরোপিয় পার্লামেন্টের এই সদস্যের চিঠির সঙ্গে বাংলাদেশের বাস্তবতার মিল নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার সন্দেহ তিনি বর্তমান বাংলাদেশ সম্পর্কে তার কাছে সঠিক তথ্য নেই, সঠিক তথ্য জানার চেষ্টাও করেননি। সম্ভবত, চিঠিটি না পড়েই স্বাক্ষর করে দিয়েছেন। কেউ টাকা-পয়সা দিয়েছে এ জন্য না পড়েই স্বাক্ষর করেছেন।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, ‘ইউরোপীয় পার্লামেন্টে প্রায় সাড়ে সাতশ সদস্য আছে। তাদের মধ্যে অনেক ভালো সদস্য আছেন। বিশ্ব সম্পর্কে, বিভিন্ন দেশ সম্পর্কে খুব ভালো জানাশোনা সদস্য আছেন। আবার অনেক অথর্ব সদস্যও আছেন। অতএব একজন সদস্যের এ ধরনের একটি চিঠি গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়।’
ইভান স্টেফানেকের চিঠির জবাবে সরকার ইইউর কাছে সঠিক তথ্য তুলে ধরার পদক্ষেপ নেবে কি না জানতে চাইলে আব্দুল মোমেন বলেন, ‘আমাদের কি করতে হবে, তা আমরা জানি।’
চিঠিতে যা রয়েছে
চিঠির শুরুতেই ইভান স্টেফানেক বাংলাদেশের ‘অস্থিতিশীল পরিস্থিতি’ উল্লেখ করতে গিয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রসঙ্গ টানেন। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদন উদ্ধৃত করে তিনি লিখেন, ‘নির্বাচনের ফলাফল পরিবর্তন এবং রাজনৈতিক ভিন্নমত দমনসহ বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দল অমানবিক আচরণ করছে, যা আমি আপনার নজরে আনতে চাই।’
জোসেপ বোরেলেরকে লেখা তিন পৃষ্ঠার ওই চিঠিতে ইভান স্টেফানেক লিখেছেন, এই মুহূর্তে পরিস্থিতি খুবই গুরুতর। কারণ, মার্কিন সরকার বাংলাদেশের পুলিশের বর্তমান মহাপরিদর্শক, যিনি আগে র্যাবের প্রধান ছিলেন, তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। বিশেষ করে টেকনাফের কাউন্সিলর একরামুল হককে ২০১৮ সালের মে মাসে হত্যাসহ গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি বিচারবহির্ভূত হত্যার জন্য এই নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। মার্কিন অর্থ মন্ত্রণালয়ের ম্যাগনিটাইনেজ বৈশ্বিক নিষেধাজ্ঞা কর্মসূচির আওতায় বাংলাদেশের আরও ছয়জন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। গত কয়েক বছর বারবার আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা এবং মার্কিন সিনেটের বিভিন্ন কমিটি র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের দাবি জানিয়ে আসছিল।
চিঠিতে ইভান স্টেফানেক বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সাফল্যের বিষয়ে লিখেন, পরপর দুইবার—২০১৮ ও ২০২১ সালে মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ সূচক এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকে মান উত্তরণের জন্য এই মর্যাদা বাংলাদেশ পাবে। বাংলাদেশ তার প্রতিবেশী দেশের চেয়ে অনেকগুলো সূচকে এগিয়ে রয়েছে। বিশেষত দুই দশক ধরে ছয় শতাংশের ওপরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি। ভবিষ্যতে অনেক অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্প শেষ হলে বাংলাদেশের আরও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে বাংলাদেশের উন্নয়নের একটা বড় বাধা হলো মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং দুর্নীতি।
এছাড়া ইভান স্টেফানেক কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরায় প্রচারিত ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার মেন’ প্রতিবেদন ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রসঙ্গও টেনেছেন চিঠিতে।
উল্লেখ্য, গত বছরের ১০ ডিসেম্বর গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র্যাবের সাবেক ও বর্তমান সাত জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর এবং রাজস্ব বিভাগ আলাদা আলাদাভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
তারও এক মাস আগে গত বছরের নভেম্বরে র্যাবকে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়ে মিশনের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেলকে চিঠি লিখে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ আন্তর্জাতিক ১২টি মানবাধিকার সংগঠন। –সমকাল
এবিসিবি/এমআই