মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি যেভাবে বাইডেনকে পুনরায় নির্বাচিত হতে প্রভাবিত করবে

যখন মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে নির্বাচনের সংঘর্ষ হওয়ার প্রসঙ্গ আসে তখন স্পষ্টতই বিষয়টি বর্তমান প্রেসিডেন্টের জন্য খারাপ খবর। বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তার অনেক পূর্বসূরীর মতো নিজের বেলাতেও এমন কিছু প্রশ্ন তোলার সুযোগ তৈরি করেছেন, যেমন ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণ। এর মধ্যে কিছু প্রসঙ্গ তার অতীত শাসকদের থেকে এসেছে যেমন আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার। বেশিরভাগই ঘটনায় উভয়ের ভূমিকা রয়েছে, যেমন গাজার বিরুদ্ধে ইসরায়েলের প্রতিশোধ ও ইরানের ভূমিকা।
আসন্ন নির্বাচনের আগে আগে এ ধরনের বিষয়গুলো প্রভাব রাখবে। বাইডেনের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে তীব্র সমালোচনা হবে এতে অবাক হওয়ারও কিছু নেই। যেভাবে বাইডেন প্রশাসনের পররাষ্ট্রনীতি ভোটারদের প্রভাবিত করতে পারে-
ফিরে দেখা আফগানিস্তান
অধিকাংশ বিশ্লেষক মনে করেন আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের মাধ্যমে বাইডেন প্রশাসনের পররাষ্ট্রনীতি সমস্যার সূত্রপাত। বর্তমানে গাজা পরিস্থিতিও নতুন করে সমস্যা সৃষ্টি করেছে।
কিন্তু ভোটারদের মনোভাব অনুমান করা কঠিন। নির্বাচন এখনো অনেক দূরে। তবে নির্বাচনে ভোটারদের ইচ্ছার ওপর আন্তর্জাতিক সমস্যার যে প্রভাব অতীতে দেখা গেছে সেই ইতিহাসের দিকে নজর দিলে ধারণা করা যায় আমেরিকানরা বিশ্বে তাদের প্রভাব নিয়ে কতটা চিন্তিত। আর সেই চিন্তার প্রভাব তাদের নেতা নির্বাচনেও দেখা যায়।
আফগানিস্তান ছেড়ে যাচ্ছে মার্কিন সেনারা
১৯৬৮ সালের পুনরাবৃত্তি!
যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে ১৯৬৮ সালের নির্বাচন। এ বছর মার্কিন গণতন্ত্র তার পররাষ্ট্রনীতিতে বেশ কয়েকটি গুরুতর সংকটের অগ্রভাগে ছিল।
মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র ও মনোনয়নের জন্য নেতৃস্থানীয় প্রার্থী রবার্ট এফ কেনেডির হত্যাকাণ্ড, নাগরিক অধিকার আন্দোলনের প্রতি সহিংস প্রতিক্রিয়া ও ভিয়েতনাম যুদ্ধের কারণে বছরটি ইতিহাসে স্মরণীয়।
১৯৬৮ সালের শুরুর দিকে বেশিরভাগ মার্কিন নাগরিক মনে করতেন রিপাবলিকান নেতা নেলসন রকফেলার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে ভিয়েতনাম যুদ্ধ থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে আনতে পারবেন। অনেক ডেমোক্রেট সমর্থকও এই যুক্তিতে বিশ্বাস করতেন। রকফেলার তখন নিউ ইয়র্কের গভর্নর হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। এ বছর রকফেলার ছাড়াও সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ও ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর রোনাল্ড রেগান ছিলেন মনোনয়ন প্রত্যাশী।
রিপাবলিকানদের দিকে মুখিয়ে ছিলেন মার্কিনীরা। ভিয়েতনাম যুদ্ধ বন্ধ ও নাগরিক অধিকারের আইনসমূহ বাস্তবায়ন করাই ছিল অধিকাংশ রিপাবলিকান সমর্থকের চাওয়া। শিকাগোতে এ নিয়ে সমাবেশও ডাকা হয়। কিন্তু সম্মেলনটিতে বিশৃঙ্খলা ও সহিংসতা দেখা দেয়। ৬৫০ জন বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ।
ডেমোক্রেট প্রার্থী হুবার্ট হামফ্রে সেবার রিচার্ড নিক্সনের কাছে নির্বাচনে হেরে যান। যদিও মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার ইতিহাস ও প্রেক্ষাপট ভিয়েতনামের থেকে ব্যাপকভাবে ভিন্ন, তবে গুরুত্বপূর্ণ মিল রয়েছে।
ভিয়েতনামের মতোই, আজকের ডেমোক্রেটিক পার্টি গাজা প্রসঙ্গে বাইডেন প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া নিয়ে দুভাগে বিভক্ত। ফেব্রুয়ারিতে মিশিগান রাজ্যের প্রাথমিক নির্বাচনে ১ লাখের বেশি ডেমোক্রেট বাইডেনকে একটি বার্তা পাঠানোর জন্য একটি সমন্বিত প্রচারণার অংশ হিসেবে ‘অনিশ্চিত’ ভোট দিয়েছেন। তিনি গাজায় ফিলিস্তিনি হত্যা বন্ধ করতে আরও পদক্ষেপ নিবেন এমনটাই আশা তাদের। ২০২০ সালের নির্বাচনে মিশিগানে মাত্র দেড় লাখে ভোটে জিতেছিলেন বাইডেন।
ইরান
ইরানও বিগত আমেরিকান নির্বাচনে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেছে। গত সপ্তাহের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আবারও এমনটা হতে পারে।
১৯৭৯ সালের ইরানি বিপ্লব ও পরবর্তী ইরানি জিম্মি সঙ্কটের ফলে তৎকালীন ডেমোক্রেটিক প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার আধুনিক আমেরিকান ইতিহাসের সবচেয়ে অপমানজনক পরাজয় ডেকে আনেন।
১৯৮০ সালের নির্বাচনের এক বছর আগে ও ইরানের বিপ্লবের মাঝখানে, সশস্ত্র ছাত্ররা তেহরানে আমেরিকান দূতাবাস দখল করে এবং ৫০টির বেশি আমেরিকানকে জিম্মি করে। সঙ্কট এক বছরের বেশি সময় ধরে চলছিল।
১৯৭৯ সালের ডিসেম্বরে আফগানিস্তানে বিপ্লব ও সোভিয়েত আক্রমণের কারণে কার্টারের কর্তৃত্ব দুর্বল হয়ে পড়ে। তার রিপাবলিকান প্রতিদ্বন্দ্বী রোনাল্ড রিগান সফলভাবে কার্টারের দুর্বলতা কাজে লাগিয়ে ‘মেইক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
১৯৬৮ সালে হামফ্রির মতো কার্টারও গো হারা হারেন। রিগানের অভিষেকের দিনই জিম্মিদের মুক্তি দেওয়া হয়।
মার্কিন নির্বাচনে পররাষ্ট্রনীতি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু নির্বাচনের ফলাফলের পরিপ্রেক্ষিতে, কীভাবে অতীতের ঘটনাগুলো উপলব্ধি করা হয় তা আরও গুরুত্বপূর্ণ।
কার্টারের পরে রিগ্যানের মতো, বাইডেন ও ডোনাল্ড ট্রাম্প তাদের অধীনে চারটি বিশৃঙ্খল বছর কাটানোর পরে বিশ্ব মঙ্গলের শক্তি হিসেবে আমেরিকার ভূমিকা ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তিনি আমেরিকানদের আশ্বস্ত করেছিলেন, বৈশ্বিক নেতৃত্বের ‘বাতিঘর’ হবে যুক্তরাষ্ট্র।
পোলিং বলছে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ আমেরিকান গাজায় যুদ্ধবিরতিকে সমর্থন করে। বাইডেনের রাজনৈতিক অক্ষমতা, ইসরায়েল থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে দূরে রাখার ব্যক্তিগত অনিচ্ছা এবং সামরিক সহায়তার শর্ত তাকে পুনরায় নির্বাচিত করার সম্ভাবনা হ্রাস করছে। তিনি পুনরায় নির্বাচনে জিততে চাইলে তাকে এ বিষয় মাথায় রেখে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
ফিলিস্তিনি জনগণের, বিশেষ করে শিশুদের দুর্দশার প্রতি বাইডেনের সহানুভূতি অভাব তার ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ণ করেছে।
এবিসিবি/এমআই