চীন রাশিয়া ফ্রান্স ফ্যাক্টর নয়, জনগণের বিরুদ্ধে যাবে না ভারত বললেন মির্জা ফখরুল
বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে প্রতিবেশী বন্ধুরাষ্ট্র ভারত অবস্থান নেবে বলে বিশ্বাস করে না বিএনপি। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, এ দেশের রাজনীতিতে চীন, রাশিয়া ও ফ্রান্স তেমন কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারে বলে মনে হয় না। ফলে তারা তেমন কোনো ফ্যাক্টর নয়।
আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে বৈঠক করে এবং সেলফি তুলে নেতাকর্মীকে উজ্জীবিত করতে খুশি হওয়ার অভিনয় করেন। একই সঙ্গে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচনে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। সরকারের পতন ঘটিয়ে নির্দলীয় সরকারের অধীনেই কেবল নির্বাচনে যাব। শীর্ষস্থানীয় নেতাদের গ্রেপ্তার ও গায়েবি মামলা দিয়েও কোনো লাভ হবে না। কীভাবে সফল আন্দোলন করা যায়– বাধাবিঘ্ন মোকাবিলার সেই অভিজ্ঞতা ইতোমধ্যে তাদের হয়ে গেছে। বিএনপিসহ অধিকাংশ দল ছাড়া দেশে কোনো নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য হবে না।
গতকাল শুক্রবার গুলশান কার্যালয়ে সমকালকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন তিনি। এ সময় মির্জা ফখরুল দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, অতীতের মতো এবার আর একতরফা কোনো নির্বাচন করতে পারবে না আওয়ামী লীগ। মিথ্যা আশ্বাসে আর বিশ্বাস নেই ভোটাধিকার হারানো দেশবাসীর। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে গণআন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটাবেন তারা। নির্দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করবেন বলে জানান বিএনপি মহাসচিব।
সমকাল : সম্প্রতি ভারতে জি২০ সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বৈঠক হয়েছে। এর পর থেকে আওয়ামী লীগের নেতাদের বেশ খুশি ও ফুরফুরে মেজাজে দেখা যাচ্ছে। এতে কি বৈঠকে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রতি ভারতের ইতিবাচক সমর্থন পাওয়ার ইঙ্গিত বহন করে?
মির্জা ফখরুল : ভারত সমর্থন দিয়েছে কিনা, আমি বলতে পারব না। অনেক সময় বিভিন্ন বিষয়ে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা খুশির চেহারা দেখান। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে দৌড়ে দৌড়ে সেলফি তুলেও খুশির চেহারা দিয়েছেন। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁর সঙ্গে সাধারণ বৈঠকেও খুশি হয়ে যান। এটি তাদের পুরোনো অভ্যাস। আন্তর্জাতিক মিডিয়া নিউইয়র্ক টাইমস ও পিটিআইর রিপোর্ট বলা হয়েছে, আজকে বাংলাদেশে গণতন্ত্র নিঃশেষ বলা যেতে পারে। লাইভ সাপোর্ট দেওয়ার কথা বলেছে তারা। সে জায়গায় সরকার কীভাবে টিকে থাকে? এমনকি আবারও ক্ষমতায় আসার কথা চিন্তা করে? এ দেশের জনগণ তো তা কখনও মেনে নেবে না। সুতরাং, তারা কার কী সমর্থন পাবে কি পাবে না– এটা আমাদের কাছে বড় কোনো বিষয় নয়। আমাদের কাছে বড় বিষয় হচ্ছে, দেশের জনগণের সমর্থন পাচ্ছে কিনা? একটা বিষয় প্রমাণিত হয়ে গেছে, এ সরকারের প্রতি জনগণের কোনো সমর্থন নেই, কোনো আস্থা নেই। জনগণ চায়, এখনই অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী সরকার বিদায় নিক।
সমকাল : আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এটিও এসেছে, শুধু আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক, বিএনপি নয় কেন?
মির্জা ফখরুল : ভারত বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক– এটা আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হলো, জনগণের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কতটা ঘনিষ্ঠ। ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক খারাপও নয় বা অঘনিষ্ঠও নয়। আমাদের সঙ্গে সব সময় ভারতের একটা যোগাযোগ ছিল, সেটা এখনও আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে।
সমকাল : বিএনপির প্রতি ভারত আস্থা রাখতে পারে না বলে গুঞ্জন রয়েছে। বিএনপি ক্ষমতায় এলে ভারতের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে বলে শঙ্কা দেশটির। কিন্তু কেন?
মির্জা ফখরুল : এ ধরনের বিষয়গুলো নিয়ে মন্তব্য করতে চাই না। এগুলো আমাদের কাছে খুব মুখ্য নয়। আমাদের কাছে মুখ্য হচ্ছে, জনগণের সমর্থন। জনগণকে নিয়েই অতীতে আমরা কয়েকবার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে এসেছি। এমনকি স্বৈরাচারকে সরানো এবং দেশ স্বাধীন করা হয়েছে। এবারও ফ্যাসিবাদী সরকারকে সরাতে সক্ষম হবো বলে বিশ্বাস করি।
সমকাল : সম্প্রতি ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁর সফরে আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে একটি ইতিবাচক সমর্থন এসেছে বলে মনে করেন অনেকে। আবার চীন এবং রাশিয়াও বর্তমান সরকারের ধারাবাহিকতার পক্ষে বলে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের এবং আপনাদের অবস্থানের বিপক্ষে যায়?
মির্জা ফখরুল : আমরা তা দেখছি না। আমরা দেখছি, জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বাংলাদেশে গণতন্ত্র নেই, মানবাধিকার নেই এবং নির্বাচনগুলো সঠিক হয়নি। ফলে এবার নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হতে হবে। সুনির্দিষ্টভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ সবাই তা বলেছে। আর চীন, রাশিয়া ও ফ্রান্স বাংলাদেশের রাজনীতিতে খুব একটা প্রভাব বিস্তার করতে পারে বলে আমার মনে হয় না।
সমকাল : কিন্তু প্রভাবশালী প্রতিবেশী হিসেবে ভারত বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটা ফ্যাক্টর?
মির্জা ফখরুল : আমি মনে করি, ভারত বাংলাদেশের জনগণের বিপক্ষে অবস্থান নেবে– এটা আমি বিশ্বাস করি না।
সমকাল : বলা হচ্ছে, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বর্তমানে বাংলাদেশ ভূরাজনীতির ‘রণক্ষেত্র’ হিসেবে পরিণত হয়েছে। এ বিষয়টাকে কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
মির্জা ফখরুল : এ সরকারের ভুল কূটনীতি এবং ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য সব ধরনের অপকর্মের পরিণতি হচ্ছে এটা। যেমন– রোহিঙ্গা ইস্যুতে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি। সমস্যা টিকিয়ে রেখে ফায়দা নিতে চায়। একইভাবে এ সরকারের ব্যর্থ কূটনৈতিক চর্চায় পরাশক্তিগুলোকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে পরস্পরের বিরুদ্ধে নিয়ে এসেছে। যে কারণে সরকার আজকে পশ্চিমাবিশ্বের সঙ্গে যেভাবে আচরণ করছে, তাতে তাদের বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। বিশ্বের বৃহৎ শক্তিগুলো এখানে ‘শীতল যুদ্ধ’ জায়গায় চলে এসেছে। এর জন্য ব্যর্থ কূটনীতিই দায়ী।
সমকাল : অনেকে মনে করেন, কিছুদিন আগে আপনাদের চলমান সরকারবিরোধী আন্দোলন যে গতি পেয়েছিল, সেটা এখন অনেকটা স্তিমিত হয়ে পড়েছে?
মির্জা ফখরুল : না, এটা সঠিক নয়। এগুলোর প্রতিটি সময়ের ব্যাপার রয়েছে। আগে থেকে আন্দোলন তীব্র গতিতে চলে গেলে, তারপর দেখা গেল– আন্দোলন টিকল না। এর কোনো মানে হয় না। ঠিক সময়মতো হবে, সেটাই কার্যকর হবে। অতীতের আন্দোলনগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখেন, শেষ সময়ে এসে আন্দোলন গতি পায় এবং তীব্র রূপ নেয়।
সমকাল : আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে। অক্টোবরের শেষে তপশিল ঘোষণা হতে পারে। আর মাত্র দেড় মাসের মধ্যে এক দফার আন্দোলন কীভাবে সফল করবেন?
মির্জা ফখরুল : সরকার পতনে আমাদের এক দফার যুগপৎ আন্দোলন চলছে। শনিবার থেকে তারুণ্যের ‘রোডমার্চ’ শুরু হবে। ১৮ সেপ্টেম্বর নতুন কর্মসূচি আসবে। তপশিল নিয়ে আমাদের চিন্তা নেই। সামনে আরও বেগবান হবে।
সমকাল : আওয়ামী লীগ তো আপনাদের প্রতিটি কর্মসূচির পাল্টা ‘শান্তি ও উন্নয়ন’ নামে সমাবেশ করছে। আবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও কঠোর অবস্থানে রয়েছে।
মির্জা ফখরুল : আমরা সবসময় রাজপথে আছি। সামনে আন্দোলন আরও তীব্র হবে। জনগণের সম্পৃক্ততার মাধ্যমে আন্দোলন সফল বলে আমরা আশাবাদী।
সমকাল : বিএনপিকে বাইরে রেখেই সরকার নির্বাচন করে ফেলবে– সম্প্রতি বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে?
মির্জা ফখরুল : আমি খুব পরিষ্কার করে একটি কথা বলি, বিএনপিসহ যারা আন্দোলনে আছে, তারা যদি সেই নির্বাচন অংশ না নেয়– তাহলে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক এবং গ্রহণযোগ্য হবে না। এর আগে আওয়ামী লীগ সেই চেষ্টা করেছে।
আওয়ামী লীগ ২০১৪ সালে নির্বাচন করেছে, ২ শতাংশ ভোটারও কেন্দ্রে যাননি। ২০১৮ সালে আরেকটি একতরফা নির্বাচন করেছে, সেবার ৫ শতাংশ ভোটারও যাননি। ওই নির্বাচন তো নির্বাচন হতে পারে না। বিশ্বের কাছে তা কখনও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
সমকাল : দেশে একটি সফল গণআন্দোলন গড়ে তুলতে সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন– সেটা কি বিএনপি করতে পেরেছে?
মির্জা ফখরুল : অনেক শ্রেণি-পেশার মানুষ আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখবেন, কী পরিমাণ মানুষ সরকারের বিরুদ্ধে তাদের মতামত ব্যক্ত করে চলেছেন। বৃহস্পতিবার আইনজীবীদের সেমিনারে সাবেক বিচারপতি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বলেছেন, এ সরকারের অধীনে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। নির্বাচন কমিশনের সেমিনারে বিশিষ্ট নাগরিকরা প্রত্যেকেই মত দিয়ে এসেছেন, একটি নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।
সমকাল : নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে বিরোধী দলের নেতাদের মামলার গতিও বেড়ে গেছে। আন্দোলন মোকাবিলায় সরকারের অতীত অভিজ্ঞতার মধ্যে কীভাবে সফল আন্দোলন করবেন?
মির্জা ফখরুল : এবার জনগণ অনেক বেশি ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। আশা করি, জনগণই প্রতিরোধ করবে। আন্দোলনে কীভাবে সফল হওয়া যায়, আমাদেরও অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে। সরকারের বাধাবিঘ্ন কীভাবে ঠেকানো যায়, বিগত দু’বারের আন্দোলনে তা মোকাবিলা করার অভিজ্ঞতাও আমাদের হয়েছে। কাজেই বিনা ভোটে নির্বাচিত অবৈধ সরকারকে এবার আর বিনা চ্যালেঞ্জ ছেড়ে দেওয়া হবে না।
সমকাল : বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব নিয়ে সংকট রয়েছে বলে আলোচনা রয়েছে। এ অবস্থায় আন্দোলন সফল হওয়া নিয়েও সংশয় প্রকাশ করছেন অনেকে?
মির্জা ফখরুল : আমাদের শীর্ষ নেতৃত্বের কোনো সংকট নেই। চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া গৃহবন্দি রয়েছেন। তাঁর অনুপস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বে তৃণমূল পর্যায় থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত দল সুন্দরভাবে পরিচালিত হচ্ছে। কোনো সমস্যা হচ্ছে না।
সমকাল : সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের এর আগে দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় বলে বক্তব্য-বিবৃতি দিয়েছেন। কিন্তু সম্প্রতি ভারত সফরের পর বেশ চুপচাপ হয়ে গেছেন।
মির্জা ফখরুল : আমরা জাতীয় পার্টির বিষয়টি সেভাবে গুরুত্ব দিই না। তাদের রাজনীতি তারা করছে। তবে কয়েক দিন দেখলাম জি এম কাদের সাহেব বলেছেন, এ সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না।
সমকাল : জামায়াতে ইসলামী আপনাদের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে নেই। তবে শুক্রবারও বিএনপির সঙ্গে মিল রেখে বিভিন্ন স্থানে মিছিল ও সমাবেশ করেছে?
মির্জা ফখরুল : জামায়াতে ইসলামী তাদের মতো করে আন্দোলন করছে। আজকে কমিউনিস্ট পার্টিসহ বহু রাজনৈতিক দল আমাদের সঙ্গে যুগপৎ কর্মসূচি ঘোষণা না করেও একই দাবিতে আন্দোলন করছে।
সমকাল : সাক্ষাৎকার দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
মির্জা ফখরুল : সমকালকেও ধন্যবাদ। -সূত্র: সমকাল
এবিসিবি/এমআই