অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে সুদূরপ্রসারী সংস্কার জরুরি -ওয়েবিনারে বক্তারা গণ
পরে বাঁ থেকে সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার, যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক আলী রীয়াজ, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান; নিচে বাঁ থেকে ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের রিচার্স ফেলো মির্জা এম হাসান, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ম. তামিম, টেকসই উন্নয়ন বিষয়ক লেখক ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব
গত ১৫ বছরে দেশে এক অসহনীয় অবস্থা তৈরি হয়েছিল। সব কাঠামো ভেঙে পড়েছে। গণ–অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন ও ১৫ বছরের জঞ্জাল দূর করতে এখন সুদূরপ্রসারী সাংবিধানিক ও প্রশাসনিক সংস্কার জরুরি। রাজনৈতিক দলগুলোকেও জন–আকাঙ্ক্ষা ধারণ করতে হবে।
আজ সোমবার এক ওয়েবিনারে আলোচকেরা এ কথা বলেন। ‘গণ–অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশ: এখন কী করতে হবে’ শীর্ষক ওই বিশেষ ওয়েবিনারের আয়োজন করে ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজ। তাতে আলোচকেরা সংসদ, বিচার বিভাগসহ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো সংস্কারের দাবি জানান।
বদিউল আলম মজুমদার বলেন, এই সংস্কারের জন্য রাজনৈতিক বন্দোবস্ত প্রয়োজন। কিছু সংস্কার পরবর্তী সময়ে করতে হবে, যাঁরা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসবেন, তাঁরা সেটি করবেন। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ–আলোচনার মাধ্যমে একটি চুক্তিতে যেতে হবে, যাতে একটি জাতীয় সনদ তৈরি করা যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, জন–আকাঙ্ক্ষার মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন এই সরকার গঠিত হয়েছে। দুটি আকঙ্ক্ষা—একটি হলো এই সরকার দ্রুত একটি নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে। অন্যটি হলো বড় রকমের পরিবর্তন আনতে হবে। সামগ্রিক কাঠামোগত পরিবর্তন প্রয়োজন। যাঁরা সরকারে আছেন, তাঁরা বলুক এই দুটি স্বপ্নের মধ্যে তাঁরা কী করতে চান।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগে এই সরকারের মামলা করা জরুরি বলে মন্তব্য করেন আলী রীয়াজ। তিনি বলেন, প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে যাওয়া যেতে পারে। যাঁরা হত্যার নির্দেশ দিয়েছেন—আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, তাঁদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি বলে তিনি মন্তব্য করেন।
বিদ্যমান সংবিধান পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, এই সংবিধান রেখে জবাবদিহিমূলক কাঠামো তৈরি করা সম্ভব নয়। এই সংবিধানেই স্বৈরতন্ত্রের বীজ বপন করা আছে। এই সংবিধান রেখে চিরস্থায়ীভাবে স্বৈরতন্ত্রের বিলোপ হবে না।
অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোকে জন–আকাঙ্ক্ষা ধারণ করতে হবে। ১৫ বছরে জঞ্জাল তৈরি হয়েছে। কাঠামো ভেঙে পড়েছে। তিনি প্রশ্ন রাখেন, পুনর্গঠন করতে তাড়াহুড়া কেন, দেশ বদলাতে চান না?
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, মানবাধিকার লঙ্ঘনের বহুমুখী ঘটনা ঘটেছে। দায়ীদের জবাবদিহি করতে হবে, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনে জাতিসংঘের সহায়তা নেওয়া দরকার। তিনি বলেন, বাক্স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও তথ্যের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। সব কালো আইন বাতিল করতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি কৌশল নির্ধারণ করে সংস্কার পরিকল্পনা করতে হবে। জনপ্রশাসন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিচার বিভাগ, সংসদ, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, তথ্য কমিশন, মানবাধিকার কমিশনসহ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ঢেলে সাজানোর কোনো বিকল্প নেই। দুর্নীতির ঘটনাগুলো নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদের মধ্যে জবাবদিহি সম্পন্ন করতে হবে। শিক্ষা ও পেশাজীবী প্রতিষ্ঠানগুলোতে দলীয় অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে হবে।
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, নির্বাচনের দাবি রাজনৈতিক দিক থেকে যৌক্তিক তবে ‘ডকট্রিন অব নেসেসিটি’ থেকে এখনই তা কতটা যৌক্তিক তা নিয়ে ভাবতে হবে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ম তামিম বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আকাঙক্ষা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ আসতে পারে রাজনৈতিক দল থেকে। রাজনৈতিক কর্তৃত্বের জন্য যেসব ব্যবস্থা আছে, সেগুলো তাঁরা সহজে পরিবর্তন করতে চান না। ১৯৯১ ও ২০০৭–০৮ সালেও এ ধরনের প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল; কিন্তু পরিবর্তন আসেনি। এর অন্যতম প্রধান কারণ বিচারহীনতা। অপরাধীদের বিচার করা যায়নি।
সাংবাদিক মনির হায়দারের সঞ্চালনায় ওয়েবিনারে ‘গণ–অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশ, এখন কী করতে হবে’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব। প্রবন্ধে তিনি রাষ্ট্র সংস্কার, রাজনৈতিক বন্দোবস্ত, প্রশাসনিক স্থিতিশীলতা, পরিসংখ্যান জালিয়াতি থামানো, অর্থনীতি পুনরুদ্ধার, বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ ঋণ পরিস্থিতি, ডিজিটাল অর্থনীতির নিরাপত্তা, মেধাভিত্তিক নিয়োগ বিষয়ে তাঁর চিন্তাভাবনা তুলে ধরেন।