Type to search

সম্পাদকীয় ও মতামত

সুশাসন প্রতিষ্ঠায় গণমাধ্যমের ভূমিকা

সুশাসনের অর্থ নির্ভুল, দক্ষ ও কার্যকরী শাসন। সুশাসনের জন্য রাষ্ট্রের ন্যায়পরায়ণ আচরণ, দুর্নীতি ও নিপীড়নমুক্ত স্বাধীন পরিবেশ ও নিরপেক্ষ এবং স্বাধীন বিচার বিভাগ অপরিহার্য। আর সুশাসনের জন্য খুব বেশি প্রয়োজন স্বাধীন ও শক্তিশালী গণমাধ্যম। স্বাধীন সংবাদমাধ্যম আর স্বাধীন বিচার বিভাগ ছাড়া সুশাসন প্রতিষ্ঠা, মানবাধিকার রক্ষা ও প্রশাসনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। স্বাধীন বিচার বিভাগ না থাকলে বিচার বিভাগে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বৃদ্ধি পায়, যা কোনো রাষ্ট্রের জন্য সুখকর নয়।

সুশাসনের বড় অন্তরায় দুর্নীতি। দুর্নীতির রাহুগ্রাস রাষ্ট্রের প্রাণশক্তিকে নিঃশেষ করে। আমাদের দেশে অব্যাহত দুর্নীতি রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করছে। দুর্নীতির কারণে রাষ্ট্রের সম্পদের অপচয় হয়, বণ্টনে অসমতা সৃষ্টি এবং আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে। এজন্য জনসচেতনতা অপরিহার্য। তা সুশাসনের চাবিকাঠিও বটে। জনগণ সচেতন না হলে, সরকার প্রশাসনযন্ত্র স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠে। কেন্দ্রীভূত ক্ষমতাচর্চা সুশাসনের অন্তরায়। গণতান্ত্রিক চর্চা, মূল্যবোধের বিকাশ, উপযুক্ত শিক্ষাব্যবস্থা, বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও অর্থনৈতিক ভারসাম্য সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন। এর সবকিছু ঠিকঠাক থাকতে প্রয়োজন শক্তিশালী গণমাধ্যম। আর এদেশের গণমাধ্যম কখনোই স্বাধীন ছিল না।

‘সুশাসন’ ও ‘গণমাধ্যম’ এ দুটি বিষয় পরস্পর গভীরভাবে সম্পৃক্ত। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা আর আইনের শাসনকে কেউ কেউ বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করছে। গণমাধ্যম রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ্ভ হিসেবে তাদের সমুচিত জবাব দেয়ার অধিকার রাখে। এক্ষেত্রে আমাদের গণমাধ্যমের ভূমিকা মোটেও জোরালো নয়। কোনো কোনো গণমাধ্যমকর্মী গণমাধ্যমের স্বাধীনতার অপব্যবহার করে ক্ষেত্রবিশেষে গ্রহণযোগ্যতা ও অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। কিছু কিছু সংবাদপত্র ব্যক্তিগত বিদ্বেষ, একপেশে খবর, অদূরদর্শী এবং পত্রিকার কাটতি বাড়ানোর জন্য নৈতিকতাবিবর্জিত সংবাদ প্রচার করে বিচার বিভাগ তথা জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। অনেক সময় মিডিয়া ট্রায়ালের ফলে বিচারক এবং বিচারপ্রার্থী জনগণ বিব্রত হয়, যা অনভিপ্রেত এবং অনাকাঙ্ক্ষিত। তবুও বলতে হয়, এদেশে সুশাসন যতটুকু প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে এজন্য গণমাধ্যমের ভূমিকা অন্যতম। মানুষের তথ্য জানার অধিকার এবং গণমাধ্যমের তথ্য জানানোর গভীর দায়বদ্ধতার প্রশ্নে সামাজিক অঙ্গীকার নিয়ে সংবাদপত্র প্রতিনিয়ত অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করছে।

সরকারের কার্যকারিতা, আইনের শাসন এবং দুর্নীতির নিয়ন্ত্রণ, দায়বদ্ধতা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সহিংসতার অনুপস্থিতি, নিয়মবিধির প্রায়োগিকতা সুশাসনের সূচক। বর্তমানে দেশে ব্যাপক উন্নয়ন হচ্ছে। দেশের মানুষের আয় বেড়েছে, এর পরও সরকারের সঙ্গে জনগণের ব্যবধান নেই বলা যাবে না। দেশে একবারেই সুশাসন নেই তাও নয়। যেটুকু ফারাক আছে তা কমিয়ে আনা সম্ভব। দেশের সরকার ও আমলাতন্ত্র যদি দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করে, তাহলে কোনো সমস্যা নেই। দেশের মানুষের স্বার্থ বিবেচনা না করে নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত থাকলে সুশাসন প্রশ্নবিদ্ধ হয়। তখনই দেশের মানুষের কষ্ট বাড়ে। তাতে দেশের অর্থনীতি বাধাগ্রস্ত হয়, বিঘ্নিত হয় দেশের মানুষের দৈনন্দিন জীবনচারিতা।

এ কথা বলতেই হয় যে, নিয়মবিধির প্রতিপালন ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বা শিল্পোন্নত দেশগুলোর চেয়ে লক্ষণীয়ভাবে অনেকটাই পিছিয়ে আছে। দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের চেয়েও বাংলাদেশের সুশাসন পরিস্থিতি নেতিবাচক। এ অবস্থা আমাদের কাম্য হতে পারে না। উপরিউক্ত সূচকগুলোর পজিটিভ দিক তৈরিতে গণমাধ্যমের ভূমিকা অপরিহার্য। তবে বর্তমানে গণমাধ্যমের ভূমিকা যতটুকু তা সন্তুষ্ট হবার মতো নয়। এ ব্যাপারে গণমাধ্যমকে আরো জোরালো ভূমিকা পালন করতে হবে। একটি দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, বাক্স্বাধীনতা, ব্যক্তিস্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা অপরিহার্য। একটি রাষ্ট্র যখন এসব নিশ্চিত করতে পারে তখনই বলা যায় যে, রাষ্ট্রে গণতন্ত্র গুণগত এবং দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, বাক্স্বাধীনতা, ব্যক্তিস্বাধীনতা খর্ব হলে গণমাধ্যমকে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে হবে। আমাদের দেশে এসব স্বাধীনতা খর্বে সংবাদপত্রের ভূমিকা জোরালো থাকে না। কোনো কোনো গণমাধ্যম পক্ষপাতিত্বমূলক ভূমিকায় থাকে।

সাংবাদিকদের ঐক্যে ও ভ্রাতৃত্বের অভাবে দেশের সুশাসন প্রতিষ্ঠায় অন্তরায় হয়। আমাদের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক্স্বাধীনতা তথা সংবাদপত্রের স্বাধীনতার কথা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, যা মৌলিক অধিকার হিসেবে আমাদের মহান সংবিধান কর্তৃক স্বীকৃত হয়েছে। এর সঙ্গে সুশাসন প্রতিষ্ঠা নিবিড়ভাবে জড়িত। সবকিছুর পরও বলতেই হয় এদেশের প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি এবং লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ইত্যাদি বিষয়ে সংবাদ প্রকাশ করে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সচেতন করার গুরুদায়িত্ব পালন করে আসছে। মিডিয়া রাষ্ট্রের বিভিন্ন কার্যক্রম নিয়ে সময়োপযোগী সংবাদ প্রকাশের মাধ্যমে নিরন্তর সহযোগিতা করে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় যুগান্তকারী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের আরো জোরালো ভূমিকা আশা করছি আমরা।

ইত্তেফাক ,  লেখক :  মীর আব্দুল আলী,  গবেষক

 

Translate »