Type to search

সম্পাদকীয় ও মতামত

বাংলাদেশ নিয়ে আল জাজিরার প্রতিবেদন ও কয়েকটি কথা

গত ১ ফেব্রুয়ারি কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আল জাজিরা ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টারস মেন’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এটিকে মিথ্যা, সম্মানহানিকর এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা বলে অভিহিত করেছে। এতে আরও বলা হয়েছে, চরমপন্থি গোষ্ঠী ও তাদের সঙ্গে সম্পর্কিত কুখ্যাত ব্যক্তিরা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত যে অপপ্রচার চালিয়ে আসছে, এটি তারই  অংশ ছাড়া আর কিছুই নয়। মন্ত্রণালয়ের প্রতিক্রিয়ায় দুটি বিষয় সুনির্দিষ্ট করে বলা হয়েছে। একটি হচ্ছে— ‘প্রধানমন্ত্রী এবং বাংলাদেশের অন্যান্য সংস্থাগুলো’ এর সঙ্গে জড়িত থাকার কোনো প্রমাণ নেই। দ্বিতীয়টি হচ্ছে— প্রতিবেদনের ঐতিহাসিক বিবরণে ‘একাত্তরের ভয়াবহ গণহত্যার কথা উল্লেখ করতে ব্যর্থ হয়েছে।’
আমরা মনে করি যে, আল জাজিরার প্রতিবেদনটি বাংলাদেশে প্রচার এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাধাগ্রস্ত বা অবরুদ্ধ না করা সরকারের একটি সুচিন্তিত ও ভালো সিদ্ধান্ত ছিল। প্রচারে বাধা দেওয়া হলে সাধারণত পাঠকের মধ্যে আরও বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। বিদেশি গণমাধ্যমের প্রতিবেদনের বিষয়ে সরকারের এমন অবস্থানকে আমরা স্বাগত জানাই। তবে, প্রতিবেদনের বিষয়ে সরকারের দেখানো প্রতিক্রিয়ায় অনুরূপ সুচিন্তিত অবস্থান দেখানো হয়েছে বলে মনে হয়নি। প্রতিক্রিয়ায় এই প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, এর জন্য সম্ভাব্য উস্কানিদাতা ও অর্থায়নকারীদের বিষয়ে বলা হয়েছে এবং এ জাতীয় প্রতিবেদন করায় আল জাজিরার উদ্দেশ্য নিয়ে সমালোচনা ও প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়েছে। তবে, আল জাজিরা যেসব বিষয়ে অভিযোগ তুলেছে, সে সব বিষয়ে কোনো বক্তব্য প্রতিবাদে স্থান পায়নি।দেশের মানুষের সত্য জানার নিশ্চয়ই আগ্রহ আছে।
কোন বিষয়ে সরকার প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে তা প্রকাশ না করে কেবলমাত্র সরকারের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করতে গিয়ে আমরা অদ্ভুত এক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি। এখন পর্যন্ত আমরা আল জাজিরার প্রতিবেদন বা এর  কোনো অংশই প্রকাশ করিনি। এমনকি এই সম্পাদকীয়তেও আমরা উত্থাপিত কোনো অভিযোগ, কোনো ব্যক্তির নাম, ভিডিওতে দেখানো কোনো নথি, ভিডিওতে দেখানো ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের সঙ্গে দণ্ডিত দুই পলাতক আসামির অংশগ্রহণ এবং ক্যামেরার সামনে বা পেছনে যারা কথা বলেছেন তাদের বিষয়ে কোনো তথ্য প্রকাশ করিনি।
আমরা মনে করি যে প্রতিবেদনে উত্থাপিত অভিযোগগুলো এড়িয়ে যাওয়া বা কার্পেটের নিচে ময়লা চাপা দেওয়ার মতো সমাধানে যাওয়া সঠিক হবে না। এমন অনেকেই আছেন যারা বিভিন্ন সময় প্রধানমন্ত্রীর পাশে ছিলেন, বিশেষ করে তার সংগ্রামের সময়গুলোতে। তারা এখন প্রধানমন্ত্রীর কৃতজ্ঞতাবোধের পুরোপুরি সুযোগ নিচ্ছেন এবং আমাদের কিছু অতি সংবেদনশীল জায়গায় প্রভাব বিস্তার করছেন। প্রতিবেদনে ইসরায়েল থেকে সংবেদনশীল টেলিফোনে আড়িপাতার যন্ত্র কেনার বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে। অথচ, দেশটিকে আমরা স্বীকৃতি দিইনি। এ ছাড়া, ভুয়া পাসপোর্ট, জাতীয় পরিচয়পত্র এবং ব্যাংক নথিগুলোর বিষয়ে বিশেষভাবে নজর দেওয়া প্রয়োজন। এগুলোর পেছনে এমন সংস্থার নাম জড়িত, যাদের সততা ও নিরপেক্ষতার ওপর আমাদের নিরাপত্তা নির্ভর করে। আমাদের নিরাপত্তা, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো এবং তাদের নেতৃত্বে যারা রয়েছেন তাদের সম্পর্কিত বিষয়ও এখানে রয়েছে। সরকার এগুলো উপেক্ষা করলে  বিপদ বাড়তে পারে।
দেশের গণমাধ্যমগুলো কেন এ জাতীয় প্রতিবেদন করছে না সে বিষয়ে জানার পুরোপুরি অধিকার রয়েছে পাঠকদের। আমাদের নিজস্ব কিছু সীমাবদ্ধতা তো রয়েছে, তার পাশাপাশি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রভাবে পরিবেশটি এমন হয়ে উঠেছে। যে কোনো জায়গায় মুক্তভাবে গণমাধ্যমের কাজের ক্ষেত্র এই আইনটি ব্যাপকভাবে সীমাবদ্ধ করেছে। সাংবাদিক ও সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় করা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও অসমর্থনযোগ্য মানহানিকর মামলাগুলো দেখলে এবং যে গতিতে মামলাগুলো নেওয়া হয়, তদন্ত করা হয়, আসামিদের গ্রেপ্তার করা হয়, কারাগারে পাঠানো হয় ও মাসের পর মাস জামিন না দিয়ে কারাবন্দি রাখা হয় তাতেই সুস্পষ্ট উত্তর পাওয়া যায়। এগুলো ছাড়াও ভয় দেখানো, হুমকি দেওয়া এবং বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দেওয়াসহ অন্যান্য আরও যে কৌশলগুলো ব্যবহার করা হয় তা বলাই বাহুল্য। তারপরও আমাদের সত্য জানানোর সংগ্রামে সক্রিয় থাকতে হবে। সেই চেষ্টা যে করছি না, তাও বলা যাবে না।
সৌজন্যে: ডেলি স্টার
Translate »