Type to search

সম্পাদকীয় ও মতামত

প্রসঙ্গ করোনা ভাইরাস: সিডনীর ডায়েরি পর্ব ২

স্বপ্না গুলশান:
(পুন:প্রকাশ ।  লেখাটি এবিসিবি নিউজে ২৮ মার্চ প্রকাশিত হয়েছিল)
বিদেশ ফেরতদের অনেকে ‘চৌদ্দ দিন একঘরে থাকা’ বা হোম কোয়ারেন্টিন বা সেলফ আইসোলেশনে থাকার নিয়ম ভাংছে অস্ট্রলিয়াতে। যে কারনে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন বাড়ছেই দেশটিতে।যেমন বিমানবন্দর দিয়ে প্রবেশ করার সময় যাকে বলা হয়েছে চৌদ্দ দিন নিজ দায়িত্ব নিয়ে একবারে ঘরে থাকবেন । বাড়ীর অন্যদের সাথে ও দুরত্ব রেখে চলবেন । তাদের অনেকেই শপিং সেন্টার বা রাস্তায় বের হয়েছেন । ধরা ও পড়েছেন পুলিশের কাছে । জরিমানা ও করা হয়েছে।
কিন্ত যা সর্বনাশ করার তা তো করেই দিয়েছেন কমিউনিটিতে। যারা বিদেশ থেকে ফেরেননি বা যাদের চৌদ্দ গোষ্ঠীর কেউ এধরনের কারো সংস্পর্শে আসেন নি তাদের অনেকেই করোনাতে আক্রান্ত হয়েছেন এখানে। কমিউনিটি ট্রান্সমিশন খুবই ভয়ংকর এধরনের সংক্রমন রোগের ক্ষেত্রে । এটি এমন একটি প্রক্রিয়াতে সংক্রমন টা একে অপরের মধ্যে ছডাতে থাকে যা গোটা এলাকা ছাডিয়ে পুরা দেশটাকেই গ্রাস করে ফেলে । অষ্ট্রেলিয়া ফেডারেল সরকার মানে স্কট মরিসনের সরকার কদিন আগেও বুঝতে পারেননি যে বিদেশ থেকে যারা তাদের শরীরে করোনা ভাইরাস নিয়ে ফিরেছেন তারা এত দ্রুত বিদুৎ গতিতে এখানকার লোকাল কমিউনিটিতে সেটা ছডিয়ে দেবেন । কেননা এদের অনেকের মধ্যে ভাইরাসের কোন লক্ষন ছিল না।
সেকারনে নিজ বাডীতে সেলফ আইসোলেশনে থাকবে চৌদ্দ দিন এমন শর্তে দেশটির ভিতরে ঢুকতে দেয়া হয়েছিল তাদের । বলে রাখি , অস্ট্রেলিয়াতে বারো জাতের লোকের বসবাস । এদের বেশীর ভাগই আপনার আমার মতো মাইগ্রেশন বা অভিবাসন নিয়ে এদেশে স্থায়ী ভাবে বসবাস করছেন । এশিযা থেকে শুরু করে আফ্রিকা, ইউরোপ , আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা সবধরনের লোকজনই আছে এখানে । নাম ধরে কিছু দেশের কথা আর বললামই না। আজীবন অনিয়মের মধ্যে চলেছেন যারা এদেশে এসেই হঠাৎ করেই কি এমন নিয়মের জালে বন্দী হওয়া সম্ভব? সুতরাং যা হবার তা হচ্ছেই। দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে কমিউনিটি সংক্রমন । মাথা ব্যথা ও বাডছে সরকারের ! কিভাবে নিয়ন্ত্রন করা যায় এ কমিউনিটি সংক্রমন । এ নিয়ে গতকালই জরুরী ভিত্তিতে ক্যানবেরাতে জাতীয় কেবিনেটের বৈঠকে বসেন প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন। বৈঠক শেষে সিদ্ধান্ত এলো – এখন থেকে হোম কোয়ারিন্টান বা সেলফ আইসোলেশন আর নিজ বাডীতে চলবেনা। বিদেশ থেকে যারাই ঢুকবেন সরাসরি পুলিশ প্রশাসনের কড়া পাহারায় তাদের কে নেয়া হবে সরকার নির্ধারিত হোটেল গুলোতে। ২৪/৭ কঠোর মনিটরিংয়ে থাকবে বিদেশফেরত এসব অস্ট্রেলিয়ান। রাজ্য সরকার ও পুলিস কে এসর কাজে সহায়তা করতে ইতিমধ্যে মাঠে নামানো হয়েছে অস্ট্রেলিয়ান সেনাবাহিনী। আর হোটেলে মনিটরিংয়ে থাকা এসব বিদেশ ফেরত লোকজনের পুরা খরচ বহন করছে রাজ্য সরকার। সিডনি বিমান বন্দর দিয়ে প্রতিদিন তিনহাজার যাত্রি প্রবেশ করে। এখন যারা আসছেন তাদের সবই অস্ট্রেলিয়ান যারা করোনা মহামারীতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আটকে পড়েছেন ।
এবার আসি ক্রুজ শীপের কথায় ।অনেক অস্ট্রেলিয়ান অবসরে যাবার পর বিভিন্ন দেশ ভ্রমন করতে বের হয়ে পড়েন জাহাজের মাধ্যমে । মাসের পর মাস তারা ওই জাহাজেই থাকেন । ঘুরে বেড়ান বিভিন্ন দেশে। জাহাজটি কখনো তিনদিন কখনো সাতদিন কখনো একমাস বিভিন্ন দেশে সমুদ্র বন্দরে অবস্থান করে। আর যাত্রীরা সেখানকার পর্যটনীয় স্থান গুলো দল বেধে ঘুরে ঘুরে দেখেন ।এয়ার লাইন্স এজেন্টের মতো এসব ক্রুজ শীপের ও এজেন্ট রয়েছে যারা খুবই ব্যস্ত সময় কাটান এসব হলিডে প্রেমিক অস্ট্রেলিয়ানদের ক্রুজ শীপের বুকিং কনফার্ম করতে । এটা শুধু অস্ট্রেলিয়ানরা নয় বরং ইউরোপ আমেরিকান এশিয়ানদের অনেকেই এমন করে সারা বছর ঘুরে বেড়ান জাহাজে । যাহোক, করোনা ভাইরাস মহামারি আকারে ছডিয়ে পড়ার আগেই এসব ক্রুজ শীপ হাজার হাজার যাত্রী নিয়ে বিভিন্ন দেশ ভ্রমনে বেরিয়েছিলেন। জাপানে আটকে থাকা ডায়মন্ড প্রিন্স ছিল এমনই একটি ক্রুজ শীপ যার যাত্রীদের বেশীরভাগই করোনা ভীইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন এবং এদের। বেশীরভাগই নিজ নিজ দেশে ফিরে গেছেন এবং ছডিয়ে দিয়েছেন ভাইরাসটি বিশ্বব্যাপী অসহনীয় পর্যায়ে।
যাহোক এমনই কয়েকটি ক্রুজ শীপ হাজার হাজার যাত্রী নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন রাজ্যের বন্দরে ঢুকছে । যাদের বেশীরভাগই অস্ট্রেলিয়ান এবং বাকি যাত্রীরা ইউরোপ , আমেরিকার । গেল সপ্তাহে রুবী প্রিন্সেস নামের একটি জাহাজ ২৭০০ যাত্রী নিয়ে সিডনি হারবারে নোঙর করে। যাত্রীদের ছেড়ে দেয়া হয়েছিল নিজ বাডীতে সেলফ আইসোলেশনে থাকার শর্তে। ভুলটা এখানেই করেছেন নিউসাউথ ওয়েলস রাজ্যের প্রিমিয়ার ।কথা রাখেন নি ঘরে ফেরা সেসব অসিরা। যারফলে নিউসাউথওয়লোসের সিডনীতে সবচেয়ে বেশি করোনা আক্রান্তের সংখ্যা। এরাই মধ্যে, ওয়েস্টান অস্ট্রেলিয়া তে দুটি আন্তর্জাতিক ক্রুজ শীপ হাজার হাজার বিদেশি যাত্রি নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করার অনুমতির অপেক্ষায় রয়েছে । এ জাহাজ দুটিতে কোন অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক নেই ।তবে এমন আন্তজাতিক যাত্রীদের ক্ষেত্রে গতকাল স্কট মরিসন সরকার ঘোষনা দিয়েছেন যে এদের কেউ জাহাজে অসুস্থ্য হলে রাজ্য সরকারের তদারকিতে বিশেষ ব্যবস্থাতে সেখানকার হাসপাতালে চিকিত্সা পাবেন এবং বিশেষ ব্যবস্থায় এসব পর্যটকদের তাদের দেশের সরকার ফিরিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করবেন । ক্রু সহ সেসব জাহাজ গুলোকে ও ফিরে যেতে হবে তাদের নিজ দেশে।
এবার আ্সি বাংলাদেশ প্রসংগে। দেশটিতে ইতিমধ্যে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন শুরু হয়েছে । যেটা ঘটেছে বিদেশ ফেরত বাংলাদেশীদের থেকে। কারন তারা হোম কোয়ারিন্টনে থাকার নিয়ম না মেনে হাট বাজার মাঠে ময়দানে ঘুরে বেডিয়েছেন। ভাইরাস টি ছডিয়ে দিয়েছেন স্থানীয়ভাবে সাধারন মানুষের মধ্যে সেটাকে বলা হচ্ছে কমিউনিটি ট্রান্সমিসন। এটি খুবই ভয়ংকর দেশটির জন্য । জনবহুল বাংলাদেশে স্থানীয় ভাবে ছডিয়ে পড়া এ সংক্রমন নিয়ন্ত্রন করা কঠিন থেকে কঠিনতর হবে। ঢাকার মীরপুর উত্তর টোলারবাগে রয়স্ক যে ব্যক্তি করোনা রোগে মারা গেছেন তিনি বা তার পরিবারের কেউ বিদেশ ফেরত নন। তিনি জানতেনই না যে করোনা ভাইরাস বাসা বেঁধেছিল তার দেহে। একবার চিন্তা করে দেখুন উনি এলাকার মসজিদে নামাজ পড়তে যেতেন । কত মুসল্লিই না গিয়েছেন ওই মসজিদে নামাজ পড়তেন । উনার সংস্পশে কত লোকাজন এসেছেন তা বের করা টাফ হবে। হয়তো উনি লোকাল বাজারেও গেছেন , রাস্তায় হাটতে বের হয়েছেন। ডেল্টা মেডিকেল হাসপাতালে চিকিৎসারত ছিলেন তিনি। উনাকে যিনি চিকিত্সা দিয়েছেতিনিও করোনাতে আক্রান্ত হয়েছেন ।.আবার যে মসজিদে নামাজ পড়তে যেতেন সেখানকার সেক্রেটারি ও করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ।ভাবুন একবার – উনার পরিবারের যে সব সদস্য আছেন তারা কে কোথায়চ দিয়েছেন , লোকাল পাবলিক বাস, রিকশা, ট্যাক্সি , উবার , পাঠাও বা সিএনজিতে চলাচল করেছেন কিনা এসব বিষয় গুলো তদন্ত করা ভীষন কঠিল হবে বাংলাদেশের জন্য । কমিউনিটি ট্রান্সমিসনটা এভাবেই শুরু হয়েছে দেশটিতে। । এমন হতে পারে বিদেশ ফেরত কেউ করোনা ভাইরাস নিয়ে মসজিদ বা বাজারে গিয়েছিলেন , যেখান থেকে সংক্রমিত হয়েছিলেন তিনি যার লক্ষন প্রকাশ পেয়েছে ১৪ দিন পর।
এভাইরাসের সবচাইতে ঝুকির দিক হলো চৌদ্দ দিন পযন্ত এটি দেহের ভিতরে বাসা বেধে থাকতে পারে কোল লক্ষন ছাড়াই। লক্ষন প্রকাশের চৌদ্দ দিন আগে রোগী কোথায় গেছেন, কার সাথে ঘনিষ্ট ভাবে মিশেছেন তা চিহ্নিত করা খুবই জরুরী। এজন্য কমিউনিটি ট্রান্সমিসন নিয়ন্ত্রনে আনতে বাংলাদেশের দরকার নিজ বাডীতে নয় যাদের মধ্যে বৈশিষ্ট দেখা যাবে বা বিদেশ ফেরত তাদের কে সরকারি ভাবে নির্দিষ্ট কোন স্থানে ২৪/৭ মনিটরিংয়ে রাখা যাতে তারা চৌদ্দ দিনের মধ্যে কোথাও বের হতে না পারে। এ বিষয়ে স্থানীয় পুলিস প্রশাসন সেলফ আইসোলেশনের জন্য নিজ নিজ এলাকা নির্ধারণ করে সেটি মনিটরিং করতে পারে কঠোরভাবে।
চীন কিন্ত এমনটি করেই তাদের করোনা সংক্রমন কমিয়ে এনেছে ।চীন যেটি করেছে যে সরকার নির্ধারিত হোটেল বা স্থানে থাকবেন ঝুকিপুর্ন সবাই তবে বিদেশ ফেরত যারা তাদেরকে যার খরচ তাকেই বহন করতে হচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার ইতিমধ্যে পাবলিকের মধ্যে সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখতে সেনাবাহিনী নামিয়েছেন যারা দেশের বিভিন্ন এলাকাতে স্থানীয় প্রাশসনকে সহায়তা করছেন । এটি একটি ভালো উদৌগ।
ঢাকার মীরপুরের উত্তরটোলারবাগ লকডাউন করে দেয়া হয়েছে। সারা টোলারবাগ এলাকা জীবানু মুক্ত করতে নানা পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। সংক্রমন নিয়ন্ত্রন করতে সাধারন ছুটি ঘোষনা করেছে । এটি ও যৌক্তিক ।
তবে এ সংকট মুহুর্তে দিনমজুর দরিদ্র মানুষের ঘরের দরজায় খাবার ও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য স্থানীয় সাংসদ , চেয়ারম্যান, মেম্বার ও সমাজের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের সমন্বয়ে নিরাপদে পৌঁছে দেয়ার নিশ্চয়তা সরকারকে দিত হবে। সরকারের এসর খাদ্য সহায়তা নিয়ে যেন এলাকার সাংসদ , মেম্বার চেয়ারম্যান বা স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিরা দুর্নীতি বা স্বজনপ্রীতি না করতে পারে তাও কেন্দ্রীয়ভাবে মনিটরিং করতে হবে। সমাজের বিত্তবানদের গরীবদের সহায়তা করতে এগিয়ে আসতে হবে।
সব কথার শেষ কথা হলো, COVD19 বা করোনা ভাইরাস সারাবিশ্বে মহামারি আকার ধারন করেছে। এ রোগের কোন প্রতিষেধক বা ওষুধ এখনো আবিষ্কার হয়নি । ইউরোপ আমেরিকা অস্ট্রেলিয়া এশিয়ার দেশ সিংগাপুর চীন জাপান সহ বেশ কটি দেশ দিনরাত চব্বিশ ঘন্টা প্রতিষেধক আবিস্কার করতে গবেষনা চালিয়ে যাচ্ছে। এ প্রতিষেধক আবিস্কার করতে হয়তো কয়েক মাস বছর ও লেগে যেতে পারে। আর ততোদিন পযন্ত আমাকে আপনাকে গোটা বিশ্ববাসীকে এসব নিয়মের মধ্যেই দিন কাটাতে হবে ।
আতংকিত না হয়ে অতি জরুরি কাজ ছাড়া বের হবেননা, সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখুন মানে কারো খুব নিকটে দাঁড়াবেন বা বসবেনন কমপক্ষে তিনহাত দুরত্ব বজায় রাখুন, হ্যান্ডশেক কোনভাবেই করবেন না, জরুরী কাজে বের হলে মাস্ক পরুন, ঘন ঘন হাত পরিস্কার করুন সাবান দিয়ে। বাইরে গেলে সম্ভব হলে সাথে ছোট হ্যান্ড স্যানিটাইজার রাখুন, টিসু বা রুমাল ব্যবহার করুন হাচি কাশির সময় , যিনি হাচি কাশি দিচ্ছেন তার থেকে নিরাপদ দুরে থাকুন।ভীড় এডিয়ে চলুন। কোন কিছু ধরলে বা বাইরে থেকে আসলে কমপক্ষে বিশ সেকেন্ড সাবান দিয়ে ভাল করে হাত ধোয়ার অভ্যাস করুন, বাইরের ব্যবহার করা কাপড় ভালভাবে পরিস্কার করুন। সর্বাপরি আপনার আমার আমাদের সচেতনতা আর পরিচ্ছন্নতাই পারবে করোনা ভাইরাসের মতো মরনঘাতি এ সংক্রামক রোগকে নিয়ন্ত্রনে আনতে।
স্বপ্না গুলশান
এডিটর , এবিসিবি নিউজ
Tags:

You Might also Like

Translate »