করোনা ভাইরাস: সিডনীর ডায়েরী
স্বপ্না গুলশান:
( পুন:প্রকাশ, লেখাটি এবিসিবি নিউজে ২৪ মার্চ প্রকাশিত হয়েছিল)
অবশেষে আমরা শুরু করলাম হোম অফিস আর মেয়ে শুরু করল হোম স্কুল । ‘নিজে নিরাপদে থাকুন; অন্যদের নিরাপদে রাখুন । তাই বাসায় থাকুন ।’ এটাই এখন বিশ্বব্যাপী শ্লোগান । করোনা ভাইরাসের নেটওয়ার্ক ভাংগার এই একটাই মহৌষধ। তাছাড়া আর কোনভাবেই বিদ্যুৎ গতিতে ছডানো এ ভাইরাসের বিস্তার থামানো সম্ভব না। তবে যারা ফ্রন্ট লাইনে কাজ করছেন যেমন ডাক্তার , নার্স , স্বাস্হ্য কর্মীসহ অন্যান্য জরুরি সেবায় নিয়েজিত তাদের কে তো যেতেই হচ্ছে / হবে বাড়ীর বাইরে কাজ করতে। ভীষন সাবধানে চলাচল করছেন তারা।
সিডনিতে ঘরে থাকা বেশীরভাগ বাবা/ মাকে এখন দুটো চাকুরি / কাজ একসাথে মেনটেন করতে হচ্ছে। প্রথম টি হলো নিজের অফিসের কাজ আর দ্বিতীয়টি হলো বাচ্চার হোম স্কুল । মানে হলো আগে যে লেসন গুলো ক্লাসে করানো হতো সেগুলো এখন বাডীতে করাতে হচ্ছে । প্রতিদিন সকাল ৮.৩০ টায় SchoolBag app এর মাধ্যমে বাচ্চার স্কুল থেকে ক্লাসের লেসন চলে আসছে । সে অনুযায়ি ক্লাস পরিচালনা করতে হচ্ছে আমাদের কে ।ক্লাস শিক্ষকের সাথে সরাসরি যোগাযোগ থাকছে গুগল লারনিং পদ্ধতিতে।
অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়াসহ অনেক রাজ্যে স্কুল পুরা বন্ধ। আমরা থাকি নিউ সাউথ ওয়েলস রাজ্যের সবচেয়ে জনবহুল শহর সিডনাীতে। করোনা ভাইরাসের মহামারি আতংকে গত সপ্তাহেই সিডনির ৩০ শতাংশ বাবা মা বাচ্চার স্কুলে আসা বন্ধ করে দিয়েছে। আমরা ছিলাম দ্বিধা দ্বন্দ্বে। কারন ফেডারেল সরকার বা রাজ্য সরকারের কাছ থেকে কোন রকম পরিস্কার দিক নির্দেশনা পাচ্ছিলামনা। এখানে জরুরি কোন কারন বা অসুস্থ্যতা ছাড়া স্কুলে না দিলে বাবা মাকে কোর্টে পযন্ত নিতে পারে সরকার । আমি গত সপ্তাহ থেকেই শুরু করে দিয়েছি হোম অফিস। নিজে হোম অফিস করে বাচ্চার স্কুলে পাঠাতে ভীষন খারাপ লাগত। আর ইতিমধ্যে সিডনীতে করোনা ছডানো শুরু করেছে দ্রুত গতিতে। আমাদের আতংক ও বাডছে।
গত সপ্তাহ পযন্ত বাচ্চার স্কুলে পাঠাতে বলছিল সরকার । নিয়েছিল নানা পদ্ধতি । যেমন সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখা, স্কুল এসেম্বলি বন্ধ, ঘন ঘন হাত ধোওয়া সহ আরো অনেক কিছু ।সরকারের এত উদৌগের পর ও কাটেনি আমাদের বাচ্চাদের নিয়ে আতংক। অবশেষে গত রোববার, রাতে প্রধানমন্ত্রী ঘোষনা দিলেন স্কুল খোলা থাকবে তবে বাচ্চার স্কুলে যাওয়াটা হবে ভলানটারী। তারমানে হলো বাবা মা বাচ্চা বাসায় রাখতে পারবেন আবার জরুরি দরকারে ইচ্ছা করলে স্কুলে ও পাঠাতে পারবেন । মানে হলো বাবামাকে কোন কৈফিয়ত দিতে হবেনা বা বাচ্চা কে অনুপস্থিত করানো হবেনা স্কুলে না গেলেও । এবিষয়ে প্রধান মন্ত্রী স্কট মরিসন ব্যাখ্যা ও দিয়েছেন। তিনি বলেছেন জরুরি সেবায় নিয়োজিত যেমন ডাক্তার নার্স তারা যেন বাচ্চা স্কুলে রেখে কাজে যেতে পারেন । স্কুল একবারে বন্ধ করে দিলে তাদের জন্য এ অপশন থাকবেনা । ফলে তাদেরকে হয়তো বাসায় থাকতে হবে বা বাচ্চাক দাদী দাদা বা নানি নানার কাছে রাখতে হবে। যা বয়স্কদের জন্য খুবই ঝুঁকিপুর্ন হতে পার।
প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, এদেশের শতকরা ত্রিশ ভাগ হেলথ কেয়ার কর্মীর স্কুল গোয়িং বাচ্চা রয়েছে। সেসব বিবেচনা করেই স্কুল খোলা রাখা হয়েছে । তবে নিউ সাউথ ওয়েলস রাজ্যের প্রিমিয়ার সোমবার সকালে বাবামা কে আহবান করেন ফেডারেল সরকার স্কুল খোলা রেখেছেন, তবে আপনারা বাচ্চা কে বাসায় রাখুন প্রাকটিকাল কারনে, দয়া করে বাসায় রাখুন । সেদিন থেকেই আমার মতো বেশীর ভাগ বাবামা বাচচার স্কুল অফ করে দিয়েছে। এবার আসি অন্য প্রসংগে। অস্ট্রেলিয়াতে যত গুলো করোনা রোগী পাওয়া গেছে তাদের শতকরা নব্বই ভাগ ট্যুরিস্ট , ক্রুজশীপ ও হলিডেতে বিদেশ থেকে ঘুরে আসা মানুষের মাধ্যমে ছডিয়েছে। সেকারনে সরকার কঠোর ট্রাভেল ব্যান জারি করেছে। বিদেশি কোন নাগরিক এখন এদেশে ঢুকতে পারবেনা এবং এখানকার কোন নাগরিক এখন বিদেশে যেতে পারবেনা । সরকার মনে করছে কোন অস্ট্রেলিয়ান এখন দেশের বাইরে গেলে সেখান থেকে ভাইরাস নিয়েই দেশে ফিরবে । তখন পরিস্থিতি আরো ভয়ংকর হবে । তাই যেসব অসি এখনো বিদেশে আছেন দেশে ফিরলেই তাদের কে ১৪,দিন বাধ্যতামুলক সেলফ আইসোলেশনে থাকতে হচ্ছে। না মানলে পুলিস যখাযথ ব্যবস্থা নিচ্ছে।
এবিষয়ে বিভিন্ন কমিউনিটি কে ও নজরদারি করতে অনুরোধকরা হয়েছে। ইতিমধ্যে সাউথ অস্ট্রেলিয়া , কুইন্সল্যান্ড, ওয়েস্টান অস্ট্রেলিয়া , নর্দান টেরিটরি সহ এখানকার অনেক রাজ্য তাদের সীমানা বন্ধ করে দিয়েছে । এ সব রাজ্যে যদি কেউ অন্য রাজ্য থেকে ঢুকতে চাই তবে তাদেরকে সরাসরি ১৪ দিন হোম কোরারিন্টান বা সেলফ আইসোলেশনে থাকতে হবে। করোনা আতংকে বিশ্বের অন্য দেশের মতো এখানে ও মানুষ যে যার মতো খাবার মজুদ করেছে। কোলস, উলওয়ার্থ , আলদি, আইজিএ, কসকো সহ এখানকার নামকরা সুপারশপের সব শেলফ খালি। চাল, আটা , ময়দা, আটা , তেল , পাস্তুা সহ নানা খাবারের সংকট । ক্রেতার চাহিদা মেটাতে পারছেনা তারা ।ইতিমধ্যে সাপ্লাই চেন দুর্বল হয়ে পড়েছে। মানুষ টয়লেট পেপার নিয়ে ও মারামারি করছে । ক্লিনিংয়ের প্রোডাক্টের সংকট । দোকানের শেলফ খালি ।
এমন করোনা মহামারীর মধ্যেই গেল সপ্তাহে প্রিন্সেস রুবী নামের এক ক্রুজ শীপ সিডনি হারবারে নোঙর করার অনুমতি দিয়েছে নিউ সাউথ ওয়েলস রাজ্যের প্রিমিয়ার মিস গ্লাডি ব্রেজেকলিন ।এ জাহাজটির প্রায় ২৭০০ এর মতো যাত্রী সিডনীতে ঢুকতে দেয়া হয়েছিল সেলফ আইসোলেশনে থাকার শর্তে।.যাদের মধ্যে একশ জন ইতিমধ্যে করোনা আক্রান্ত ও একজন মারা গেছেন।
নিউসাউথ ওয়েলস রাজ্যের প্রিমিয়ারের এমন সিদ্ধান্তে সিডনির মানুষ ভীষন নারাজ । তারা মনে করছে প্রিমিয়ারের এমন সিদ্ধান্তে নিউ সাউথ ওয়েলস রাজ্যে বিশেষত সিডনীতে করোনার সংক্রমন ব্যাপক হারে বাডছে। এদিকে ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়াতে একটি ক্রুজশীপ নোঙর করতে অনুমতি দেন নি সেখানকার রাজ্য প্রধান । ফলে জাহাজ টি র দুশ যাত্রী আটকে আছেন যাদের কেউ অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক নন।সেখানে আজ সকালে আরো একটি শীপ আন্তর্জাতিক পর্যটকসহ পৌঁছেছে। শুক্রবার আরো একটি শীপ আসবে সেখানে। তবে রাজ্য প্রধানের সাফ জবাব সিডনির মতো ভুল তারা করবেনা। কোন শীপ নোঙর করতে দেয়া হবেনা। জাহাজগুলোকে রিফুয়েল করতে দেয়া হয়েছে কড়া পাহারায় । জাহাজের মধ্যেই যাত্রীদের জরুরি চিকিত্সা দেয়া হচ্ছে দরকার পড়লে । বলা হয়েছে যেখান থেকে এসেছে শীপগুলোকে সেখানেই চলে যেতে । এ নিয়ে স্কট মরিসনের ফেডারেল সরকারের কথা মানছেনা রাজ্য সরকার ।
বলে রাখি, এখানে ফেডারেল সরকার হলো কেন্দ্রীয় সরকার আর প্রতিটি রাজ্যে তাদের নিজস্ব আইন রয়েছে। প্রিমিয়ার হলো এখানকার রাজ্য প্রধান । রাজ্যের স্বার্থে প্রিমিয়ার যে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন তবে ফেডারেল সরকারের সাথে আলোচনা করেই করতে চায় তারা। অস্ট্রেলিয়ার অর্থনীতিতে করোনা ভাইরাস বিশাল নেগেটিভ প্রভাব ফেলেছে। ডলারের দাম একদম নীচে নেমে গেছে।দেশটির সবচেয়ে বড় আন্তজাতিক এয়ারলাইন্স কান্তাস গেল সপ্তাহে ৮০ হাজার স্টাফ ছাটাই করেছে । ভার্জিন এয়ার ও আজ আট হাজার কর্মী ছাঁটাই করেছে। পুরা দেশ জুড়ে চলছে শাটডাউন । হোটেল , দোকান পাট সব বন্ধ । ফলে হাজার হাজার মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে । তবে এসব মানুষ কে আর্থিক সহায়তা করতে ও অর্থনীতি বাঁচাতে স্কট মরিসন সরকার অনুদান ঘোষনা করেছে মিলিয়ন বিলিয়ন ডলার । ইতিমধ্যে এ সহায়তা পেতে দেশটির সেন্টার লিংকের সামনে গতকাল লাইন ধরেছে আশি হাজারের মতো কর্মহীন হয়ে পড়া মানুষ ।
জানিয়ে রাখি , এখানে প্রতিটি নাগরিক তাদের সংকটের সময় সরকারের কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা পেয়ে থাকে। যেটি প্রদান করা হয় সরকারের নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠান সেন্টার লিংকের মাধ্যমে। সহায়তা পেতে যারা অনলাইনে দরখাস্ত করতে পারেনি তাঁরাই লাইন ধরেছে সেন্টার লিংকের সামনে ।
গতকাল প্রধানমন্ত্রী এখানকার পরিস্থিতিকে অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসে সবচাইতে দুর্বিসহ কঠিন সময় বলে উল্লেখ করছেন। করোনা পরিস্থিতি নিয়ে দেশের জনগনের আপডেট দিতে নিয়মিত ব্রিফিং করছেন তিনি। এরকম কঠিন সময়ে অস্ট্রেলিয়ানদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ও মনোবল অটুট রাখতে যা করা দরকার সেটাই করছেন প্রধানমন্ত্রী । করোনা ভাইরাসে এ পযন্ত নিউ সাউথ ওয়েলস রাজ্যে ১ হাজার ২৯ জন, ভিক্টোরিয়ায় ৪১১ জন, কুইন্সল্যান্ডে ৩৯৭, ওয়েস্টান অস্ট্রেলিয়ায় ১৭৫, সাউথ অস্ট্রেলিয়ায় ১৭০, অস্ট্রেলিয়ান ক্যাপিটাল টেরিটরিতে ৩৯, তাসমানিয়াতে২৬, নর্দান টেরিটরিতে ৫ জন আক্রান্ত হয়েছেন । যাদের অধিকাংশ সম্প্রতি ইউরোপ ও আমেরিকা থেকে অস্ট্রেলিয়াতে ফিরেছেন । দেশটিতে এ পযন্ত মোট করোনাভাইরাস কনফার্ম কেস দুহাজার দুশ বায়ান্ন্ জন ( ২,২৫২ । মারা গেছেন আট জন ; যাদের ৭ জন নিউসাউথ ওয়েলস ও একজন ওয়েস্টান অস্ট্রেলিয়ার বাসিন্দা ছিলেন।
(স্বপ্না গুলশান, এডিটর , এবিসিবি নিউজ)