রাজনীতি ও ভোট থেকে আওয়ামী লীগকে বিরত রাখার প্রশ্নে নতুন বিতর্ক, কী বলছে বিএনপিসহ অন্য দল

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগসহ যেসব দল গত তিনটি নির্বাচনে অংশ নিয়েছে, তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বাধা দেবে এ সরকার। এ ধরনের একটি বক্তব্য নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে। বিএনপিসহ বিভিন্ন দল বলেছে, সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সঙ্গে আলোচনা না করে নির্বাচন ও রাজনীতি নিয়ে বা দলগুলোকে রাজনীতি থেকে বিরত রাখার কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে সমস্যা তৈরি হবে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনের পতনের পর দলটির রাজনীতি নিষিদ্ধ করার প্রশ্নে নানা মহলে আলোচনা চলছে। এমন প্রেক্ষাপটে প্রথমবারের মতো অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে কোনো ব্রিফিংয়ে আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিক কর্মসূচি করতে না দেওয়ার বিষয়ে বক্তব্য এসেছে।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপ শেষে গত শনিবার সরকারের পক্ষে প্রেস ব্রিফিংয়ে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত রাখার বিষয়ে প্রশ্ন করেন একজন সাংবাদিক। জবাবে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম বলেন, যারা গত তিনটি নির্বাচনে অংশ নিয়েছে, অবৈধভাবে নির্বাচিত হয়ে তারা জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। এ বিষয়ে সরকারের অবস্থান স্পষ্ট—তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে বাধা তৈরি করবে। কীভাবে বাধা বাস্তবায়িত হবে, সেটা দেখতে পাবেন। এটার আইনি ও প্রশাসনিক দিক আছে। যখন নির্বাচনী কার্যক্রম শুরু হবে, তখন বিষয়গুলো স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
‘সরকার সিদ্ধান্ত নেয়নি’
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম অবশ্য গতকাল বলেন, বিতর্কিত গত তিনটি নির্বাচনে অংশ নিয়ে যাঁরা অবৈধভাবে নির্বাচিত হয়েছেন, তাঁদের নিয়ে মানুষের মধ্যে উদ্বেগ ও প্রশ্ন রয়েছে। সেটাই তিনি শনিবারের প্রেস ব্রিফিংয়ে তুলে ধরেছেন। তিনি আরও বলেন, কাউকে নির্বাচন ও রাজনীতি থেকে বিরত রাখা বা রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বাধা দেওয়ার ব্যাপারে সরকার এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠিত হওয়ার পর সরকার সব দলের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে।
গত তিনটি নির্বাচন (২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪) নিয়েই বিতর্ক রয়েছে। ২০১৪ সালে একতরফা নির্বাচনে বিএনপিসহ বেশির ভাগ দল অংশ নেয়নি। ২০২৪ সালেও মিত্রদের সঙ্গে আসন ভাগাভাগির মাধ্যমে নির্বাচনের নামে প্রহসন করে আওয়ামী লীগ। এ নির্বাচনের ছয় মাসের মাথায় ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সরকারের পতন হয়।
গণতন্ত্র মঞ্চের নেতা জোনায়েদ সাকি
২০১৮ সালের নির্বাচনে আগের রাতেই ভোট শেষ করাসহ গুরুতর অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। তবে ওই নির্বাচনে বিএনপিসহ সব দল অংশ নিয়েছিল।
বিএনপি নেতারা বলছেন, তাঁরা ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নিলেও ওই ভোটের অনিয়ম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। নির্বাচনে অংশ নেওয়া এবং ফ্যাসিস্ট শাসনকে সহায়তা করা এক বিষয় নয় বলে যুক্তি দেন তাঁরা। জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক মতিউর রহমান আকন্দ প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নিলেও ভোটের দিন সকালেই অনিয়মের কারণে ভোট বর্জন করেছেন।
শেখ হাসিনার শাসনে গত তিনটি সংসদেই মিত্র বা সহযোগী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল জাতীয় পার্টি। এখন আওয়ামী লীগের শাসনে গত তিনটি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়ে যে প্রশ্ন উঠেছে, সে ব্যাপারে জাপার মহাসচিব মুজিবুল হক বলেন, তাঁদের দল নির্বাচনে অংশ নিয়ে সংবিধানবিরোধী বা বেআইনি কিছু করেনি।
আওয়ামী লীগ নিয়ে চাপ
সরকারি সূত্রগুলো বলছে, আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা যাতে নির্বাচনে অংশ নিতে না পারে, সে ব্যাপারে আন্দোলনের ছাত্র নেতৃত্বসহ বিভিন্ন মহল থেকে সরকারের ওপর চাপ আছে। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবিও রয়েছে। এমনকি সরকারের ভেতরেও কারও কারও এমন চিন্তা থাকতে পারে। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সংলাপে এলডিপিসহ কয়েকটি দল আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দাবি তুলেছে। কিন্তু অন্যতম প্রধান দল বিএনপির নেতারা বলছেন, তাঁরা কোনো দলকে নিষিদ্ধ করার পক্ষে নন। তাঁরা মনে করেন, এ সিদ্ধান্ত নেবে জনগণ।
আওয়ামী লীগ আমলের নির্বাচনগুলো নিয়ে বিতর্কের অন্যতম বিষয় হচ্ছে দলটি বিরোধী দলগুলোকে কোনো সুযোগ না দিয়ে একতরফাভাবে নির্বাচন করেছে। বিএনপিসহ বেশির ভাগ দলকে নির্বাচনের বাইরে রাখা হয়। ফলে ওই নির্বাচনের বৈধতার প্রশ্নও এসেছে। এখন আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে নির্বাচন হলে তাতেও প্রশ্ন তোলার সুযোগ তৈরি হতে পারে। বিএনপি নেতাদেরও কেউ কেউ এমনটা ধারণা করেন।
তবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক আল মাসুদ হাসানুজ্জামান বলেন, কোনো দলের নির্বাচনে অংশ নেওয়া, না নেওয়ার প্রশ্নে সব দলের সঙ্গে আলোচনা করে নির্বাচন কমিশনই সিদ্ধান্ত নেবে। তবে এবার সরকার পতনের আন্দোলনে অনেক হত্যাকাণ্ড হয়েছে। ফলে ভিন্ন একটা প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে এবং তাদের ব্যাপারে কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়টি আলোচনায় আসছে।
-প্রথম আলো