ঘুমিয়ে থাকা দুদক জেগেছে সরকার পতনে
২০২৪ সালের ৫ই আগস্ট পর্যন্ত সরকারের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান ছিল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের কাছে জিম্মি। এরমধ্যে বাদ যায়নি দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক)। এই জিম্মি দশা থেকে সংস্থাটি মুক্তি পায় গত ৫ই আগস্ট। এর আগ পর্যন্ত শত শত আওয়ামী লীগ নেতা, সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগ থাকলেও তা আমলে নেয়া হতো না। বিশেষ করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দপ্তর থেকে ফরমায়েশি চিঠি পাওয়া মাত্রই দুদকের অনুসন্ধান শুরু হতো। গত ৫ই আগস্ট থেকে এই সংস্কৃতির পরিবর্তন হয়েছে।
রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে গতি পায় দুদকের কার্যক্রমে। ৮ই আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শপথ হয়। ১৪ই আগস্ট থেকে দুদকের কার্যক্রমে ভিন্নতা আসে। আওয়ামী লীগ সরকারের অন্তত ১০০ মন্ত্রী-এমপি, সাবেক শীর্ষ আমলা, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, ব্যবসায়ী, পুলিশের শীর্ষ কর্তা ব্যক্তিদের দুর্নীতির খোঁজে মাঠে নামে দুদক। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম দুই মাসে সংস্থাটির অনুসন্ধানের তালিকায় ১৮০ জনের নাম থাকলেও তৃতীয় মাসে তা দুইশ’ ছাড়িয়ে যায়। এ তালিকার বেশির ভাগই আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী-এমপি এবং বিগত সরকারের ঘনিষ্ঠজন। শুধু তাই নয়, তাদের নামে-বেনামে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ফ্রিজ চলমান রয়েছে। অনুসন্ধান কাজ আরও গতিশীল করতে শতাধিক ব্যক্তির বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। যদিও এরইমধ্যে অনেকে দেশত্যাগ করেছেন। আবার কিছু শীর্ষ নেতাকর্মী গ্রেপ্তারও হয়েছেন। তাদের অধিকাংশের বিরুদ্ধেই অভিযোগ, ক্ষমতার অপব্যবহার, ঘুষ গ্রহণ, ব্যাংকের ঋণ নিয়ে লুটপাট, অর্থ পাচার, নিয়োগ বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, কমিশন বাণিজ্য, সরকারি ও বেসরকারি জমি-সম্পত্তি দখল, লুটপাটসহ নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে হাজার কোটি টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করেছেন। তবে দুর্নীতি অনুসন্ধানের তালিকায় আওয়ামী সরকারের প্রায় সব মন্ত্রীর নাম থাকলেও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কোনো অনুসন্ধান শুরু হয়নি ২৯শে অক্টোবর বিদায় নেয়া মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহর নেতৃত্বাধীন কমিশনের আমলে। ৪২ দিন নেতৃত্বশূন্য দুদকের দায়িত্ব নেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেন। বছরের শেষ দিকে চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের শুরুতেই একের পর এক মামলার অনুমোদন দেয় তার কমিশন। সে সঙ্গে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধেও অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। এখন পর্যন্ত বিভিন্ন প্রকল্পে অনিয়মের অভিযোগ পেয়ে অন্তত পাঁচটি অনুসন্ধান শুরু করে সংস্থাটি।
বছর জুড়ে আলোচনায় বেনজীর-মতিউর
২০২৪ সালে দুদক আলোচনায় থাকে শুধুমাত্র সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের দুর্নীতি অনুসন্ধানের জন্য। যদিও গুঞ্জন রয়েছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে মতানৈক্যর কারণেই বেনজীরের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু হয়। গত মে মাসে সাবেক এই আইজিপি’র সম্পদের তথ্য তুলে ধরে একটি সংবাদপত্র। তার পর পরই তড়িঘড়ি করে অনুসন্ধানে নামে দুদক। এক মাসের ব্যবধানে বেনজীরের সব সম্পদ জব্দও করে সংস্থাটি। তবে অনুসন্ধানটি থমকে যায় ৫ই আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর। এ সময় অন্য এমপি মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চালাতে গিয়ে বেনজীরের মামলা প্রস্তুত থাকার পরও অনুমোদন পেতে সময় লাগে। পরবর্তীতে ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেনের নেতৃত্বাধীন কমিশন দায়িত্ব নেয়ার পর পরই মামলা দায়ের করে দুদক।
অন্যদিকে ঈদুল আজহার দুদিন আগে ১৫ লাখ টাকায় একটি ছাগল কিনতে গিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হন মুশফিকুর রহমান (ইফাত) নামের তরুণ। সেই সূত্রে ধরেই তার বাবা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আলোচিত সাবেক সদস্য মতিউর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা সম্পদের খোঁজে নামে দুদক। সর্বশেষ গত ১৫ই ডিসেম্বর মতিউর রহমান ও তার দ্বিতীয় স্ত্রীর বিরুদ্ধে ১১ কোটি ১৮ লাখ ৮৬ হাজার ১২০ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন ও সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগে দুটি মামলা দায়ের করে দুদক।
-মানবজমিন