প্রকল্প পরিচালকের অনিয়ম : রেলের ১৫০ কোচ কেনার প্রক্রিয়াতেই ৩ বছর পার
দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ১৫০টি রেলকোচ কিনতে সে দেশের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। তবে এগুলো সংগ্রহে ক্রয় প্রস্তাবে বিধিবিধান মানা হয়নি। বাংলাদেশ রেলওয়ের ওই প্রকল্পের পরিচালক মোহাম্মদ হাসান মনসুর নিজেই বিধি-বিধান মানেননি। সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি এ জন্য তদন্ত করার নির্দেশ দেয়। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ রেলওয়ের পক্ষ থেকেও ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এ বিষয়ে একাধিক অভিযোগ তোলা হয়। রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
এদিকে ২০১৭ সালের ১ জুলাই প্রকল্প অনুমোদন হলেও চুক্তি হতেই তিন বছর পার হয়ে যায় মূলত প্রকল্প পরিচালকের ঢিলেমির কারণে। এখন চুক্তি স্বাক্ষরের পর কবে প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে তাও অনিশ্চিত। রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ইস্পাতের তৈরি ১৫০টি রেলকোচ কিনতে চলতি বছর ২০২০ সালে গত ২৯ জুলাই কোরিয়ার একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করেছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। বাংলাদেশ রেলওয়ের জন্য ২০টি মিটারগেজ ডিজেল ইলেকট্রিক লোকোমোটিভ ও ১৫০টি মিটারগেজ যাত্রীবাহী ক্যারেজ সংগ্রহ প্রকল্পের আওতায় এসব কোচ সংগ্রহের চুক্তি হয়েছে। প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দক্ষিণ কোরিয়ার সুংশিন আরএসটি-পসকো ইন্টারন্যাশনাল যৌথ কোম্পানি। প্রকল্পের চুক্তি মূল্য ৬৫৮ কোটি ৮১ লাখ ৩০ হাজার টাকা। প্রকল্পটি দক্ষিণ কোরিয়ার এক্সিম ব্যাংকের অর্থায়নে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। চুক্তি স্বাক্ষরের দিন থেকে ১৮ থেকে ৩০ মাসের মধ্যে কোচগুলো বাংলাদেশ রেলওয়ের কাছে সরবরাহের কথা রয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এসব কোচ কেনার জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি হলেও এ সংক্রান্ত ক্রয় প্রস্তাবে বিধিবিধান যথাযথভাবে মানা হয়নি। চলতি বছর গত ২৪ জুন অনুষ্ঠিত সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির ভার্চুয়াল সভায় বাংলাদেশ রেলওয়ের জন্য ২০টি মিটারগেজ ডিজেল ইলেকট্রিক লোকোমোটিভ ও ১৫০টি মিটারগেজ যাত্রীবাহী ক্যারেজ সংগ্রহ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় ১৫০টি মিটারগেজ যাত্রীবাহী ক্যারেজের ক্রয় প্রস্তাবের প্রক্রিয়ায় বিধি-বিধান অনুসরণ না করার বিষয়টি উঠে আসে। সভায় এ জন্য রেলপথ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন ও পরিকল্পনা) প্রণব কুমার ঘোষকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সদস্য করা হয় একই মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. আলী কবীরকে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এই কমিটি ক্রয় প্রস্তাবের প্রক্রিয়ায় বিধিবিধান না মানার জন্য প্রকল্প পরিচালককে দায়ী করেছে। ক্রয় প্রস্তাবটি পরীক্ষা করে সেটি প্রক্রিয়া করতে বিধিবিধানে ব্যত্যয় সৃষ্টিকারী কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করে ১৫ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে দাখিলের সিদ্ধান্ত হয়েছিল ওই সভার। ওই সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে কমিটি তদন্ত করেছে। এ ব্যাপারে তদন্ত কমিটির সদস্য, রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. আলী কবীর বলেন, আমরা প্রতিবেদন দিয়েছি।
এ ছাড়া বাংলাদেশ রেলওয়ের পক্ষ থেকে বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করে প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ হাসান মনসুরের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ আনা হয়েছে। যদিও প্রকল্প পরিচালক দায় এড়ানোর চেষ্টা করেছেন।
রেলপথ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ রেলওয়ের পক্ষ থেকে ১৫০টি এমজি ক্যারেজ শীর্ষক প্রকল্পের প্রস্তাব প্রক্রিয়ায় ২০টি মিটারগেজ ডিজেল ইলেকট্রিক লোকোমোটিভ এবং ১৫০টি মিটারগেজ যাত্রীবাহী ক্যারেজ সংগ্রহ শীর্ষক প্রকল্পের পরিচালক মোহাম্মদ হাসান মনসুরের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ উঠে আসে। নথিপত্র থেকে জানা গেছে, ইডিসিএফ কোরিয়ার আর্থিক সহায়তায় বাংলাদেশ রেলওয়ের জন্য ১৫০টি এমজি ক্যারেজ শীর্ষক প্রকল্পের কারিগরি দরপত্র মূল্যায়ন প্রতিবেদন ইডিসিএফ কোরিয়া বরাবর পাঠানোর আগে ক্রয়কারী কার্যালয় বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ প্রধানের কাছ থেকে অনুমোদন নেওয়া হয়নি। বাংলাদেশ রেলওয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে- ‘তা দাফতরিক শৃঙ্খলার পরিপন্থি’। এ ছাড়া প্রকল্পের আওতায় গত ২৯ জুলাইয়ে সম্পাদিত চুক্তিপত্র অনুসারে, লেটার অব ক্রেডিট খোলার কমিশন বাবদ নথিতে ০ দশমিক শূন্য ৭০ উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু সোনালি ব্যাংকের চিঠিতে এলসি খোলার কমিশন বাবদ প্রতি কোয়ার্টার ০ দশমিক ০৭০ শতাংশ উল্লেখ করা হয়েছে। প্রকল্প পরিচালককে এ ব্যাপারে পাঠানো কৈফিয়তপত্রে এ আচরণকে অনিয়ম ঘটানোর অভিপ্রায় অদক্ষতা এবং কর্তব্যে উদাসীনতার শামিল বলে মন্তব্য করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে।
প্রকল্পের পরিচালক মোহাম্মদ হাসান মনসুরের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. শামছুজ্জামান গত ২৩ আগস্ট তার কাছে লিখিতভাবে কৈয়িফত তলব করেন। গত ২ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদ হাসান মনসুর কৈফিয়তের জবাবে জানান, ইডিসিএফ কোরিয়ার আর্থিক সহায়তায় বাংলাদেশ রেলওয়ের জন্য ১৫০টি মিটারগেজ ক্যারেজ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে টেকনিক্যাল বিড ইভ্যুলেশন রিপোর্ট কোরিয়ায় এক্সিম ব্যাংকে পাঠানো হয়। এর আগে দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সব সদস্যে স্বাক্ষর নিয়ে এই রিপোর্ট দরপত্রের তখনকার কারিগরি মূল্যায়ন কমিটির প্রধান এবং অতিরিক্ত মহাপরিচালক (আরএস) সৈয়দ ফারুক আহমদের কাছে উপস্থাপন করা হয়।
তার অনুমোদনক্রমে টেকনিক্যাল বিড ইভ্যুলেশন রিপোর্ট কোরিয়ার এক্সিম ব্যাংকে পাঠানো হয়। তিনি তা পাঠানোর আগে অনুমতি নেওয়ার জন্য ক্রয়কারী কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ প্রধানের কাছে পাঠাতে পারতেন। এ ছাড়াও তিনি উল্লেখ করেন, এর আগে ২০টি মিটারগেজ লোকোমোটিভের টেকনিক্যাল বিড ইভ্যুলেশন রিপোর্ট কোরিয়ার এক্সিম ব্যাংকে পাঠানো হয়নি। তখন প্রকল্প পরিচালক আবদুল মতিন চৌধুরী এ ক্ষেত্রে ক্রয়কারী কর্তৃপক্ষ প্রধানের অনুমোদন নেননি। এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক আবদুল মতিন চৌধুরীকে অনুসরণ করেছেন বলে মোহাম্মদ হাসান মনসুর তার দায় এড়ানোর চেষ্টা করেন। লেটার অব ক্রেডিটের কমিশনের হারের ক্ষেত্রে ভুলটি নিজের দৃষ্টিগোচর না হওয়ার জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করেন মোহাম্মদ হাসান মনসুর। তিনি অভিযোগ থেকে অব্যাহতির জন্য অনুরোধ জানান বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালকের কাছে।
প্রসঙ্গত, দক্ষিণ কোরিয়ার এ কোচগুলো রেলবহরে যুক্ত হলে বেশি সেবা দেওয়া সম্ভব হবে। তাতে যাত্রীরা সুফল পাবে। এসব কোচে স্টেইনলেস স্টিল বডি, বায়ো-টয়লেট যুক্ত থাকবে, স্বয়ংক্রিয় এয়ার ব্রেক ব্যবস্থা, স্বয়ংক্রিয় স্লাইডিং ডোরসহ আধুনিক সুবিধা যুক্ত থাকবে। ১৫০টি কোচের মধ্যে রয়েছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত স্লিপিং বার্থ ৩০টি, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত চেয়ার কোচ ৩৮টি, শোভন চেয়ার মোট ৪৪টি, খাবার গাড়িসহ শোভন চেয়ার কোচ ১৬টি, পাওয়ার গাড়িসহ শোভন চেয়ারকোচ ১২টি, রাষ্ট্রীয় পরিদর্শনের জন্য বুলেটপ্রুফ গাড়ি একটি, খাবার গাড়ি একটি, পাওয়ার গাড়ি একটি এবং পরিদর্শন কার একটি। অভিযুক্ত প্রকল্প কর্মকর্তা মোহাম্মদ হাসান মনসুর তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের বিষয়ে মন্তব্য করতে চাননি।