Type to search

জাতীয় বাংলাদেশ

২ মাস ধরে চলে শাহবাগে সমাবেশের প্রস্তুতি, বিভিন্ন জেলায় আটক শতাধিক

‘অহিংস গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশ’ নামের একটি ব্যানারে ২৫শে নভেম্বরকে ডেটলাইন ধরে শুরু হয় প্রস্তুতি এবং প্রচারণা। প্রায় দুই মাস ধরে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মাঝে এক রকম প্রকাশ্যেই সমাবেশের প্রচারণা চালানো হয়। বিনা সুদে এবং বিনা জামানতে সর্বনিম্ন এক লাখ টাকা ঋণ দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে শাহবাগে সমাবেশে যোগ দিতে প্রলুব্ধ করা হয়। এক্ষেত্রেও নেয়া হয় আরেকটি প্রতারণার আশ্রয়। প্রথমে নারী-পুরুষ নির্বিশেষ প্রত্যেকের জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি জমা নেয় চক্রটি। এরপর ঢাকায় যাওয়ার গাড়িভাড়া বাবত জনপ্রতি ৫০০ টাকা দেয়া হয়।

কিশোরগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামের অন্তত ১০ হাজার নারী-পুরুষ এভাবে শাহবাগের সমাবেশে যোগ দেয়ার প্রস্তুতি নেয়। রোববার রাতে তাদের অনেকেই ‘অহিংস গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশ’ এর রিজার্ভ করা বাসে যাত্রী হয়ে ওঠেন। কিন্তু ব্যাপকভাবে ঢাকায় যাওয়ার বিষয়টি স্থানীয়ভাবে সন্দেহ সৃষ্টি করলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা সক্রিয় হন। তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং সেনাবাহিনীকে বিষয়টি জানালে জেলার বিভিন্নস্থানে অন্তত ১০টি যাত্রীবাহী বাস আটক করে যাত্রীদের ফেরৎ পাঠানো হয়। বিষয়টি নিয়ে রাতভর পুরো জেলায় তোলপাড় চলে। ফেরৎ যাত্রীদের অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগস্টের শেষ সপ্তাহ থেকে জেলার বিভিন্ন প্রত্যন্ত গ্রামে সমাবেশের প্রচারণা চালানো হয়। এজন্যে এলাকাভিত্তিক কমিটিও গঠন করা হয়। এলাকায় এলাকায় লিফলেট বিতরণ করা হয়। লিফলেটে উল্লেখ করা হয়, কৃষক, শ্রমিক, হকার, বেকার তথা সকল জনগণ থেকে ভ্যাট, ট্যাক্স হিসাবে আদায় করা লক্ষ কোটি টাকা ক্ষমতাশ্রিত একটি হায়েনার দল স্বাধীনতার পর থেকেই লুটপাট করছে। লুণ্ঠিত অর্থ উদ্ধার করবো, বিনা সুদে পুঁজি নেবো।

‘অবৈধ অর্থ উদ্ধার ও গণমুখী বিনিয়োগ জাতীয় সংস্থা’ শিরোনামে দুর্নীতিবিরোধী বিশেষ আইন প্রণয়নের দাবিতে ২৫ নভেম্বর, ২০২৪ সোমবার সকাল ১০টায় ঢাকার শাহবাগ মোড়ে ‘অবস্থান কর্মসূচি’ পালন করা হবে। বিনা সুদে, বিনা জামানতে এক লাখ থেকে এক কোটি টাকা পর্যন্ত পুঁজি পেয়ে দারিদ্র মুক্তিতে আগ্রহী সর্বস্তরের জনগণকে অবস্থান কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছি। লিফলেটে ‘অহিংস গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশ’র আহ্বায়ক হিসেবে আ. ব. ম. মোস্তফা আমীন উল্লেখ করা হয়। লিফলেটটির প্রচারে জিয়াউর রহমান, মাহবুবুল আলম চৌধুরী, জালাল উদ্দীন আহমেদ ও কামাল হোসেন আজাদ এই চারজনের নাম ও মোবাইল নম্বর উল্লেখ করা হয়। তাড়াইল উপজেলার দিগদাইড় ইউনিয়নের ভাদেরা গ্রামের ফিরোজা আক্তার বলেন, ঢাকায় গেলে আমাদের এক লাখ টাকা করে সুদছাড়া ঋণ দিবে বলেছে। ঢাকায় যাওয়ার বাসভাড়ার জন্য আমরা জনপ্রতি ৫০০ টাকাও পেয়েছি। কিন্তু বাস যেতে না দেয়ায় আমরা বাড়ি ফিরে এসেছি। একইরকম কথা বলেন গ্রামটির অন্তত শতাধিক নারী-পুরুষ। তারা জানান, তারা কোন দাবি দাওয়ার বিষয়ে আন্দোলনের কথা জানেন না। ঢাকায় গেলে তারা কৃষিকাজসহ নানা কাজের জন্য মাথাপিছু এক লাখ টাকা করে বিনাসুদে ঋণ পাবেন, এই আশ্বাস পেয়েছিলেন। এ কারণেই তারা ঢাকা যেতে চেয়েছিলেন। ইটনা উপজেলার চৌগাংগা ইউনিয়নের সংগঠক হিসেবে কাজ করেছেন নূর মিয়া, সুমন মিয়া, জাফর, শহীদুল্লাহ, পাখি আক্তার ও হেনা আক্তার। তাদের বাসটি আটক করার পর পরই তারা গাঢাকা দেন।

মানিকগঞ্জে আটক ৫
এদিকে মানিকগঞ্জ থেকে লোকজন ঢাকায় নিয়ে প্রতারণার অভিযোগ পাঁচজনকে আটক করেছে পুলিশ। সোমবার দুপুরে মানিকগঞ্জ পৌর এলাকার জরিনা কলেজ মোড় এলাকা থেকে তিনজন এবং সিঙ্গাইর বাসস্ট্যান্ড থেকে দুই’জনকে আটক করা হয়। আটককৃতরা হলেন- মানিকগঞ্জ পৌর এলাকার দবির হোসেন, তার স্ত্রী চামিলী আক্তার ও হাসিনা আক্তার এবং সিঙ্গাইর বাসস্ট্যান্ড এলাকা থেকে দেলোয়ার হোসেন ও জহুরা বেগম। তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

মানিকগঞ্জ থেকে সোমবার ভোর ৫টার দিকে বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা লোকজন নিয়ে জরিনা কলেজ মোড় এলাকায় দবির হোসেনের বাড়ির সামনে থেকে ৬টি বাসে করে শাহবাগের উদ্দেশ্য রওনা হয়। শাহাবাগ যাওয়ার পর পরিস্থিতি খারাপ দেখে ওই বাসে করেই দুপুরে মানিকগঞ্জ ফিরে আসেন তারা। এরপর দবিরের বাড়ি ঘেরাও করেন এসব লোকজন।  বেলা ২টার দিকে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হওয়ায় পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে। এ সময় দবির, তার স্ত্রী চামিলী ও হাসিনাকে আটক করে পুলিশ। একই অভিযোগে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সিঙ্গাইর বাসস্ট্যান্ড থেকে দেলোয়ার ও জহুরাকে আটক করা হয়েছে বলে জানান সিঙ্গাইর থানার ওসি মো. জাহিদুল ইসলাম। মানিকগঞ্জ সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) স্বপন কুমার সরকার বলেন, আটক ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। পরবর্তীতে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নেয়া হবে।

সাভারে আটক ৩
এদিকে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের আমিনবাজার এলাকায় বিভিন্ন যানবাহনে তল্লাশি চালায় পুলিশ। গতকাল সকাল থেকে দিনভর এই চেকপোস্ট কার্যক্রম পরিচালনা করে সাভার মডেল থানা পুলিশ ও আমিনবাজার ফাঁড়ির পুলিশ।
পুলিশ জানায়, ‘অহিংস আন্দোলন বাংলাদেশ্থ নামে একটি সংগঠন বিনা সুদে এক লাখ থেকে এক কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে বিভিন্ন জেলা থেকে বয়স্ক নারী ও পুরুষদের নিয়ে ঢাকার শাহবাগে গণজমায়েতের মাধ্যমে দেশে অরাজকতা চেষ্টার পরিকল্পনা করছে একটি বিশেষ মহলের সদস্যরা। সুনির্দিষ্ট গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে ঢাকার প্রবেশদ্বার আমিনবাজারে চেকপোস্ট কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছে। চেকপোস্ট কার্যক্রম চলাকালে মানিকগঞ্জ থেকে আসা দু’টি বাস আটক করা হয়। এ সময় বাসে অবস্থানকারী বয়স্ক নারী-পুরুষদের ভুল বুঝানো হয়েছে বলে সতর্ক করে দিয়ে ফেরত পাঠানো হয়েছে। দিনভর সন্দেহভাজন মাইক্রোবাস, হায়েস, ও বাসসহ বিভিন্ন যানবাহনে তল্লাশি অভিযান পরিচালানা করা হয়। এ সময় আরও তিনটি বাসে করে ঢাকায় প্রবেশের চেষ্টাকারীদের আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। আটকৃতদের কাছ থেকে অহিংস আন্দোলন বাংলাদেশে এর দুটি ব্যানার জব্দ করা হয়েছে।

লক্ষ্মীপুরে শতাধিক নারী-পুরুষ আটক
এদিকে রোববার রাতে ঢাকায় যাত্রাকালে লক্ষ্মীপুরের রামগতি-কমলনগরে ৩ শতাধিক নারী-পুরুষ স্থানীয় জনতা ও পুলিশের হাতে আটক হয়। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে আসে কমলনগর থানা পুলিশ ও সেনাবাহিনীর একটি দল। পরে পুলিশ ৪টি মাইক্রোবাস, ৫টি বড় বাসসহ ১১ জনকে থানায় আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করে।  গতকাল দুপুর দেড়টার দিকে বিষয়টি নিশ্চিত করেন রামগতি থানার ওসি মো. কবির হোসেন। তিনি জানান, দু’টি গাড়িসহ ৪২ জনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। মূলহোতাদের বিরুদ্ধে মামলার প্রস্তুতি চলছে। এদের মধ্যে তিনজন মূলহোতা পাওয়া গেছে। একই কথা বলেন কমলনগর থানার ওসি মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম, তিনি বলেন সরকারকে বিব্রত করতে ও ষড়যন্ত্রে ফেলতে কুচক্রী মহল নারী-পুরুষ সমাবেশ করতে ঢাকায় যাওয়ার সময় জনতার হাতে ৪টি মাইক্রোবাস, ৩টি বড় বাসসহ ৩ শতাধিক মানুষ আটক হয়। এরমধ্যে বাস-মাইক্রোসহ ১১ নারী-পুরুষকে আটক করে থানায় রেখে তথ্য উদ্‌ঘাটন করার চেষ্টা চলছে। বেশির ভাগ শিশুকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। আর কিছুকে জিম্মায় দেয়া হয়।

ভূঞাপুরে আটক ১৩
এদিকে ভূঞাপুর (টাঙ্গাইল) প্রতিনিধি জানান, টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরে ঋণ দেয়ার কথা বলে ঢাকায় সমাবেশে নেয়ার সময় ১৩জনকে আটক করেছে পুলিশ। সোমবার সকালে ভূঞাপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে তাদের আটক করা হয়। এ সময় একটি হায়েস গাড়ি জব্দ করা হয়। আটকৃতরা হলেন, ভূঞাপুর উপজেলার মহিরউদ্দিন, খায়রুল, সাগর, সামাদ, মোতালেব, ঠাণ্ডু ও রহিমা এবং গোপালপুর উপজেলার আব্দুর রশিদ, জয়নাল, শিল্পী, নাজমা, সামিরন ও হাফিজা।
জানা যায়, ‘অহিংস আন্দোলন বাংলাদেশ’- নামের একটি সংগঠন বিনাসুদে একলাখ থেকে এক কোটি টাকা ঋণ দেয়ার প্রলোভনে নারী ও পুরুষদের নিয়ে ঢাকায় যাচ্ছিল। পরে বাসস্ট্যান্ড এলাকায় পৌঁছলে তাদের আটক করে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। এর আগে রোববার রাতে দুই নারীকে আটক করা হয়।
এ বিষয়ে ভূঞাপুর থানার ওসি একেএম রেজাউল করিম জানান, অহিংস আন্দোলন বাংলাদেশ নামের একটি সংগঠনের ব্যানারে সুদ ছাড়া মোটা অঙ্কের টাকার ঋণ দেয়ার প্রলোভনে তাদের ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার পথে আটক করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে মামলা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলেও জানান তিনি।

-মানবজমিন

Translate »