Type to search

বাংলাদেশ

স্বাস্থ্যবিধি মানে না কেউ : করোনায় সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়ছে

বিশেষ প্রতিনিধি : দেশে গত দুদিনে করোনাভাইরাসে মৃত্যু ও সংক্রমণ বেড়েছে। এক দিনেই আরও ৩৯ জনের মৃত্যু হয়েছে, যা গত ৫৮ দিনের মধ্যে সর্বোচ্চ। ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে আরও ২ হাজার ২১২ জন করোনায় সংক্রমিত হয়েছে। এ সংখ্যা গত ৭৬ দিনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।

এদিকে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি এড়াতে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক হলেও মোটেও মানা হচ্ছে না স্বাস্থ্যবিধি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে গণপরিবহনেও মাস্ক ছাড়াই গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে অনেক যাত্রী। খোলা বাজারগুলোতে যেসব জায়গায় প্রচুর জনসমাগম হয় সেখানেও বহু লোককেই মাস্ক ছাড়া কাজকর্ম করতে দেখা যায়। সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি থাকলেও নানা অজুহাতে লোকে মাস্ক পরতে অনীহা দেখাচ্ছে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শীতে আবার সংক্রমণ বেড়ে যেতে পারে। টিকা আসার আগ পর্যন্ত নতুন এই ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধের মূল উপায় হলো স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। মাস্ক পরা, কিছু সময় পরপর সাবান-পানি দিয়ে হাত ধোয়া, জনসমাগম এড়িয়ে চলা ও সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা। কিন্তু এই স্বাস্থ্যবিধিগুলো মেনে চলার ক্ষেত্রে ঢিলেঢালা ভাব দেখা যাচ্ছে। এতে সংক্রমণ আবার বাড়তে শুরু করেছে।

করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করা হলেও অনেকেই তা না মানায় ঢাকায় ভ্রাম্যমাণ আদালত বসাতে যাচ্ছে সরকার। সবার মাস্ক পরা নিশ্চিত করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকে ইতোমধ্যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে গত সোমবার জানিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম।

আর স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক জানিয়েছেন, বিদেশফেরত যাত্রীদের জন্য করোনা নেগেটিভ সনদ আবার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। করোনা নেগেটিভ সনদ না আনতে পারলে ১৪ দিন বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে। তিনি বলেন, বিভিন্ন দেশে সংক্রমণ আবার বাড়ছে, এর মধ্যেই বিদেশ থেকে মানুষ আসছে, অনেকে বাইরে যাচ্ছে। ভাইরাসের বিস্তার রোধেই করোনাভাইরাস পরীক্ষার সনদ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। বিমানবন্দর, স্থলবন্দর বা সমুদ্রবন্দর- যে পথেই দেশে আসুক, সব জায়গায় এই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সব জায়গায় কোয়ারেন্টাইনেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে।

জনগণ উদাসীন থাকলে সংক্রমণ বাড়বে উল্লেখ করে মন্ত্রী আরও বলেন, আমাদের একার পক্ষে করোনার সেকেন্ড ওয়েভ মোকাবিলা করা সম্ভব হবে নয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সংক্রমণ রোধ করতে পারবে না। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সবার অংশগ্রহণ প্রয়োজন। জনগণই পারে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করতে।

বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রথম সংক্রমণ ধরা পড়ে গত ৮ মার্চ। এরপর প্রায় ৮ মাস পার হতে চলেছে। নানা কারণ দেখিয়ে অনেকেই মাস্ক পরেন না। লক্ষ্মীবাজারের এক দোকানদার বলে, মাস্ক পরলে গরম লাগে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত মাস্ক না পরেই সে দোকানদারি করে। সে বলে, মাস্ক পরা থাকলে কাস্টমাররা আমার কথা বুঝতে পারে না। সে জানায়, করোনাভাইরাস সংক্রমণের ভয় আমি করি না। রাস্তার পাশে খাবার বিক্রেতারাও মাস্ক ছাড়াই সব কাজ করছে। কয়েকজন জানায়, করোনাভাইরাস বড়লোকদের রোগ, গরিব মানুষের এতে কিছু হবে না।

সোমবার মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত জানানোর সময় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ একটু বেড়ে যাচ্ছে মনে হচ্ছে। সে জন্য আরেকটু সতর্ক হওয়ার জন্য বলা হয়েছে। সবার মাস্ক পরা নিশ্চিত করতে ঢাকায় এই সপ্তাহেই ভ্রাম্যমাণ আদালত নামবে।

স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে, ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ১১৭টি ল্যাবে ১৫ হাজার ৯৯০টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এ পর্যন্ত পরীক্ষা হয়েছে ২৫ লাখ ৭২ হাজার ৯৫২টি নমুনা। ২৪ ঘণ্টায় নমুনা পরীক্ষার বিবেচনায় শনাক্তের হার ১৩ দশমিক ৮৩ শতাংশ, এ পর্যন্ত মোট শনাক্তের হার ১৬ দশমিক ৯৭ শতাংশ। শনাক্ত বিবেচনায় সুস্থতার হার ৮০ দশমিক ৮১ শতাংশ এবং মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৪৩ শতাংশ।

২৪ ঘণ্টায় যারা মারা গেছেন তাদের মধ্যে ৩০ জন পুরুষ আর নারী ৯ জন। তাদের সবাই হাসপাতালে মারা গেছেন। তাদের মধ্যে ২৪ জনের বয়স ছিল ৬০ বছরের বেশি, ১০ জনের বয়স ৫১ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে, ২ জনের বয়স ৪১ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে এবং ১ জন করে মোট ৩ জনের বয়স ৩১ থেকে ৪০, ২১ থেকে ৩০ ও ১১ থেকে ২০ বছরের মধ্যে। মৃতদের মধ্যে ২২ জন ঢাকা বিভাগের, ৫ জন করে ১০ জন চট্টগ্রাম ও রংপুর বিভাগের, ৩ জন রাজশাহী বিভাগের এবং ২ জন করে মোট ৪ জন বরিশাল ও সিলেট বিভাগের বাসিন্দা ছিলেন।

গত ২৬ অক্টোবর করোনায় আক্রান্ত রোগী ৪ লাখ পেরিয়ে যায়। এর মধ্যে গত ২ জুলাই ৪ হাজার ১৯ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়, যা এক দিনের সর্বোচ্চ শনাক্ত। প্রথম রোগী শনাক্তের ১০ দিন পর ১৮ মার্চ দেশে প্রথম মৃত্যু হয়। ৪ নভেম্বর তা ৬ হাজার ছাড়িয়ে যায়। এর মধ্যে ৩০ জুন এক দিনেই ৬৪ জনের মৃত্যুর খবর জানানো হয়, যা এক দিনের সর্বোচ্চ মৃত্যু।

জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় বিশ্বে শনাক্তের দিক থেকে ২৪তম স্থানে আছে বাংলাদেশ, আর মৃতের সংখ্যায় রয়েছে ৩২তম অবস্থানে। বিশ্বে এ পর্যন্ত শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ইতোমধ্যে সাড়ে ৫ কোটি পেরিয়ে গেছে; মৃতের সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে ১৩ লাখ ২৮ হাজারের ঘরে।

অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ভ্যাকসিন পেতে প্রস্তুত বাংলাদেশ : অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের তৈরি করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিনের জন্য ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি করেছে বাংলাদেশ। চুক্তি অনুযায়ী প্রথম দফায় বাংলাদেশ ৩ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন আনবে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রথম দিকে যাতে ভ্যাকসিন আনা যায় সেই পরিকল্পনায় এগোচ্ছে সরকার। এরই মধ্যে সরকারের টিকা কেনার আর্থিক প্রস্তুতি শুরু হয়েছে।

জানা গেছে, প্রথম দফায় ভ্যাকসিন আনতে বাংলাদেশকে পরিশোধ করতে হবে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা। ভ্যাকিসেনের প্রতি ডোজে খরচ পড়বে ৪ ডলার অর্থাৎ বাংলাদেশি মুদ্রায় ৩৩৯ টাকা। বিক্রি হবে ৫ ডলারে বা ৪২৩ টাকায়। ভ্যাকসিন জনসাধারণকে বিনা পয়সাও দেওয়া হতে পারে। তবে এ বিষয়ে এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি সরকার।

দেশের সাড়ে ১৬ কোটি মানুষের ভ্যাকসিন কিনতে প্রয়োজন হবে প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অর্থ বিভাগের কাছে ভ্যাকসিনের জন্য ১ হাজার ২৭১ কোটি টাকা চেয়েছে। সোমবার ভ্যাকসিন কিনতে ৬৩৫ কোটি টাকা ছাড় করেছে অর্থ বিভাগ। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে করোনা মোকাবিলা বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১০ হাজার কোটি টাকা। অন্যদিকে উন্নয়ন সহযোগীরা ভ্যাকসিন কিনতে ৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

অর্থ বরাদ্দের বিষয়ে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. আবদুল মান্নান জানান, যে অর্থ ছাড় করা হয়েছে তা প্রাথমিক লট। পর্যায়ক্রমে বাকি অর্থ ছাড় করা হবে বলে জানান তিনি। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে একযোগে কাজ করছে গোটা বিশ্ব। এ দৌড়ে সবচেয়ে এগিয়ে চীন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়াসহ আরও কয়েকটি দেশ।

ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ওষুধ প্রস্তুতকারক কোম্পানি ফাইজার ও মর্ডানা চূড়ান্ত পরীক্ষায় তাদের ভ্যাকসিন ৯০ ও ৯৫ ভাগ কার্য়কর বলে দাবি করেছে। চলতি বছরের শেষে তারা বাজারে ভ্যাকসিন আনতে পারে। অন্যদিকে আশা করা হচ্ছে, যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ডের আবিষ্কৃত ভ্যাকসিন আগামী মাসের মধ্যে বাজারে আসবে। সে ভ্যাকসিনই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পাওয়ার চেষ্টা করছে বাংলাদেশ।

Translate »