সার্বজনীন পেনশনে নতুন স্কিম, কী লাভ, কী ক্ষতি?

সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় নতুন স্কিম আনলো সরকার। এর ফলে দেশের চারশোর বেশি স্ব-শাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যৎ কর্মীদের বাধ্যতামূলকভাবে এই কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত হতে হবে।
জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ বলছে, এর ফলে এ সকল প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অবসরের পর মাসিক ভাতা পাবেন।
নতুন এই পরিবর্তন আনতে কর্তৃপক্ষ প্রত্যয় নামে নতুন একটি স্কিম যুক্ত করেছে সাত মাস আগে দেশে প্রথমবারের মতো চালু হওয়া সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায়।
পাশাপাশি, আগে প্রভিডেন্ট ফান্ডে সংস্থার প্রদানকৃত অর্থ কর্মচারীর ‘কন্ট্রিবিউশন’ এর চেয়ে কম হলেও প্রত্যয় স্কিমে প্রতিষ্ঠানকে কর্মীর সমপরিমাণ টাকা জমা দিতে হবে এমন শর্ত থাকায় পেনশনার অধিক লাভবান হবেন।
তবে এই স্কিমে বর্তমান ব্যবস্থার মতো অবসরের পর এককালীন অর্থ পাওয়া যাবে না এবং সরকারি কর্মকর্তাদের তুলনায় বৈষম্যের শিকার হবেন এমন যুক্তি দেখিয়ে এর বিরোধিতা করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা।
বুধবার ২০ই মার্চ অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে নতুন এই স্কিমের বিষয়ে বিস্তারিত জানানো হয়েছে।
এর আগে, গত ১৩ মার্চ সরকার এ বিষয়ে দু’টি পৃথক প্রজ্ঞাপন জারি করে আলোচ্য প্রতিষ্ঠানসমূহের কর্মচারিগণের জন্য প্রযোজ্য প্রত্যয় স্কিমের রূপরেখা ঘোষণা করেছে।
গত বছরের অগাস্টে বাংলাদেশে চালু করা হয় সার্বজনীন পেনশন। তখন এতে চারটি স্কিম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। সাত মাসের মাথায় এতে যুক্ত করা হলো ‘প্রত্যয়’ নামে নতুন এই স্কিম।
প্রত্যয় স্কিমের আওতায় রাখা হয়েছে, ‘স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় সংস্থা এবং তাদের অধীনস্থ অঙ্গ প্রতিষ্ঠানগুলোকে।’
পেনশন কর্তৃপক্ষ বলছে, নতুন স্কিমটি ভিন্ন আঙ্গিকের। এর ফলে এসব প্রতিষ্ঠানে যারা ভবিষ্যতে যোগদান করবেন তারা অবসরে গেলে যেন পেনশন পান সেই বিষয়টি নিশ্চিত করা যাবে।

গত সপ্তাহে প্রজ্ঞাপন জারি করে অর্থ মন্ত্রণালয় জানায়, ২০২৪ সালের পহেলা জুলাই থেকে এসব প্রতিষ্ঠানে যারা যোগদান করবেন তাদের বাধ্যতামূলকভাবে সার্বজনীন পেনশনের সর্বশেষ স্কিমের আওতাভুক্ত করতে হবে।
কিন্তু এর ফলে বর্তমানে প্রচলিত ব্যবস্থার মতো অবসরোত্তর সুবিধা মেলবে কিনা তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন কিছু স্বায়ত্ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা।
তবে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ বলছে, আগে তহবিলে সংস্থার প্রদানকৃত অর্থ ছিল কর্মচারীর ‘কন্ট্রিবিউশন’ এর চেয়ে কম কিন্তু প্রত্যয় স্কিমে প্রতিষ্ঠানকে কর্মীর সমপরিমাণ টাকা জমা দিতে হবে। এতে পেনশনার অধিক লাভবান হবেন।
সরকারি কর্মচারীদের পরিসংখ্যান, ২০২২ এর তথ্য অনুযায়ী স্ব বা স্বায়ত্তশাসিতসহ অনুরূপ রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় সোয়া চার লাখ।
এই ধরনের প্রতিষ্ঠানের আওতায় রয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংক, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস, বিআরটিসি, পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনসহ সকল রাষ্ট্রীয় করপোরেশন, সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন ইনস্টিটিউট।
অর্থ বিভাগের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, প্রত্যয় স্কিমের আওতায় এলেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীর স্বার্থ ক্ষুণ্ন হবে না এবং বিদ্যমান পেনশন/আনুতোষিক সুবিধা অক্ষুণ্ন থাকবে।
যাদের এখনো অন্তত ১০ বছর চাকরির সময়সীমা আছে তারাও চাইলে প্রত্যয় স্কিমে অংশগ্রহণ করতে পারবেন।

জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান কবিরুল ইজদানী খান বলেন, নতুন স্কিমটি ভিন্ন আঙ্গিকের। ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের যৌথ কন্ট্রিবিউশনের মাধ্যমে যে টাকা মাসিক ভিত্তিতে জমা হবে তার মূল টাকা ও মুনাফার উপর অবসরে গেলে মাসিক ভিত্তিতে পেনশন দেয়া হবে।
বর্তমানে স্বায়ত্তশাসিত ও রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ‘প্রদেয় ভবিষ্য তহবিল’-সিপিএফ এর মাধ্যমে অবসরকালীন সুবিধা পেয়ে আসছেন।
এই ব্যবস্থায় মূল বেতন থেকে টাকা জমা রাখতে হয় তহবিলে। কর্মীরা জমা দেয় বেতনের ১০ শতাংশ এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান দিয়ে থাকে আট দশমিক ৩৩ শতাংশ।
মোট তহবিলের বিপরীতে সরকার ১১ থেকে ১৩ শতাংশ হারে সুদ দিয়ে থাকে।
এ টাকা পেনশনে যাওয়ার পর অবসরভোগীরা এককালীন অর্থ হিসেবে পেয়ে থাকেন।
অন্যদিকে, সরকারি কর্মচারীরা ‘সাধারণ ভবিষ্য তহবিল’-জিপিএফের মাধ্যমে অবসরোত্তর সুবিধা পেয়ে থাকেন। তারা এককালীন অর্থের পাশাপাশি মাসিক ভাতা সুবিধা পান।
কিন্তু, কেবল সিপিএফ নির্ভর হলে এককালীন সুবিধা পেলেও মাসিক ভাতা অর্থাৎ পেনশন মেলে না।
কবিরুল ইজদানী খান বলেন, প্রত্যয় স্কিম ওই প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রয়োজন ছিল। কারণ, এর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পেনশন কাঠামোর বাইরে ছিলেন।
তার দাবি, পেনশনার যে পরিমাণ অর্থ জমা দিবেন তার ‘বহুগুণ’ বেশি তিনি পেনশন হিসেবে পাবেন।
বিরোধিতা কেন?
প্রজ্ঞাপন জারির পরপরই এটির বিরোধিতা করে বিবৃতি দেয় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন।
ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক নিজামুল হক ভূঁইয়া বলেন, সার্বজনীন হলে সেটি সবার জন্যই হওয়া উচিত। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বাইরে রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্ত করা হলে এই ব্যবস্থা বৈষম্য উসকে দেবে।
তাদের শঙ্কা, এই স্কিম কার্যকর হলে আগামীতে যোগ দেবেন এমন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের আর্থিক সুবিধা কমে যাবে।
যুক্তি হিসেবে মি. ভূইয়া বলেন, এককালীন আর্থিক সুবিধা নতুনরা পাবেন কিনা এটা স্পষ্ট নয়।
“পেনশন, এককালীন সুবিধা এ সমস্ত ব্যাপারে এখানে বিশদভাবে কিছু বলা হয়নি,” যোগ করেন তিনি।
অধ্যাপক ভূঁইয়া মনে করেন, অবসরকালীন নিশ্চয়তা একই রকম না থাকলে আগামীতে মেধাবীরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় আসতে নিরুৎসাহিত হবেন।
এই ইস্যুতে বুধবার বৈঠকে বসে শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন। আগামী সপ্তাহের মধ্যে সবাই বিবৃতি দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। পরবর্তীতে আন্দোলনে নামার চিন্তাভাবনাও করছেন তারা।
শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের পর্যবেক্ষণের পর যদি প্রয়োজন হয় এবং সুযোগ থাকে তাহলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে আলাপ আলোচনা করবেন বলে বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এস এম মাকসুদ কামাল।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোও ‘প্রত্যয়’ নামের এই স্কিমের আওতায় পড়বে বলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।
অবসরের পর এককালীন আর্থিক সুবিধা না মিললে এখাতের ভবিষ্যত কর্মকর্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, বিবিসি বাংলার কাছে এমন শঙ্কার কথা জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জনতা ব্যাংকের এক কর্মকর্তা।
পেনশন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান কবিরুল ইজদানী খান বলেন, এটা যে ভালো উদ্যোগ তাতে সন্দেহ নেই। যেহেতু নতুন ধারণা, মানুষকে সময় দিতে হবে বিষয়টি বুঝতে। তখন জনগণ এতে স্বেচ্ছায় অংশগ্রহণ করবে।
এ পর্যন্ত সার্বজনীন পেনশনের জন্য প্রায় ৪০ হাজার মানুষ রেজিস্ট্রেশন করেছে।
এটির গুরুত্ব উপলদ্ধি করে ভবিষ্যতে সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করেন মি. খান।

অন্য চার পেনশন স্কিম
উদ্যোগের শুরুতে সরকার মোট ছয়টি স্কিমের কথা ঘোষণা করে। তবে প্রাথমিকভাবে চালু হয় চারটি স্কিম। সেগুলো হলো:
প্রবাস
এটি শুধু বিদেশে কর্মরত বা অবস্থানকারী বাংলাদেশি নাগরিকের জন্য। এর মাসিক চাঁদার হার ধরা হয়েছে পাঁচ হাজার, সাড়ে সাত হাজার ও ১০ হাজার টাকা করে।
ব্যক্তি চাইলে এই চাঁদার সমপরিমাণ অর্থ তিনি যে দেশে আছেন সে দেশের মুদ্রায় দিতে পারবেন। আবার দেশে এসে দেশি মুদ্রায়ও দিতে পারবেন।
এছাড়া প্রয়োজনে প্রবাস স্কিম পরিবর্তনেরও সুযোগ থাকছে।
প্রগতি
এই স্কিম বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের জন্য। এক্ষেত্রেও তিন ভাগে চাঁদার হার ভাগ করা হয়েছে।
কেউ চাইলে মাসে দুই হাজার, তিন হাজার বা পাঁচ হাজার টাকা করে দিয়ে এই স্কিমে অংশ নিতে পারবে।
আবার প্রতিষ্ঠান বা প্রতিষ্ঠানের মালিকও প্রগতি স্কিমে অংশ গ্রহণ করতে পারবে। সেক্ষেত্রে মোট চাঁদার অর্ধেক কর্মচারী এবং বাকি অর্ধেক প্রতিষ্ঠান বহন করবে।

সুরক্ষা
এই স্কিমটা স্বনির্ভর ব্যক্তির জন্য। অর্থাৎ কেউ কোথাও চাকরি করছেন না কিন্তু নিজে উপার্জন করতে পারেন, তারা সুরক্ষা স্কিমে অংশ নিতে পারবেন।
এর আওতায় পড়েন ফ্রিল্যান্সার, কৃষক, শ্রমিক ইত্যাদি পেশার লোকজন।
এই স্কিমে চাঁদার হার চার রকম- মাসে এক হাজার, দুই হাজার, তিন হাজার ও পাঁচ হাজার টাকা করে।
সমতা
এই স্কিমে চাঁদার হার একটিই – এক হাজার টাকা। তবে এক্ষেত্রে প্রতিমাসে ব্যক্তি দেবে পাঁচশ টাকা আর বাকি পাঁচশো দেবে সরকার।
মূলত দারিদ্রসীমার নিচে বসবাসরত স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য এই স্কিম। দারিদ্রসীমা নির্ধারণ করার দায়িত্ব বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর।
যেমন বর্তমানে বছরে যাদের আয় ৬০ হাজার টাকার মধ্যে তারাই কেবল এই স্কিমের অন্তর্ভুক্ত হবেন।-বিবিসি বাংলা
এবিসিবি/এমআই