পদ্মা সেতু : দিন বদলের হাওয়া দক্ষিণে
দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের কাছে পদ্মা সেতু নিয়ে আবেগটা একটু বেশিই। কারণ সেতুটি চালু হলে সবচেয়ে বেশি উপকার হবে এই অঞ্চলের মানুষের। তাই পদ্মা সেতু নিয়ে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের চাওয়া-পাওয়া বা আশা-আকাঙ্ক্ষার কমতি নেই। অধীর আগ্রহে দিন গুনছেন তারা- কবে চালু হবে স্বপ্নের পদ্মা সেতু।
গত বৃহস্পতিবার পদ্মা সেতুর সর্বশেষ অর্থাৎ ৪১তম স্প্যানটি বসার মধ্য দিয়ে এ এলাকার মানুষ তাদের লালিত স্বপ্নের খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। তাদের আশা পদ্মা সেতু জীবন বদলে দেবে এই এলাকার মানুষের।
পদ্মা সেতু এখন আর কোনো গল্প নয়, বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে। ফলে দক্ষিণাঞ্চলবাসী বিশেষ করে ফরিদপুরবাসী জননেত্রী শেখ হাসিনার কাছে বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ। ফরিদপুরবাসীর পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানানো হচ্ছে।
ফরিদপুর-৪ আসনের সংসদ সদস্য ও আওয়ামী যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মুজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন বলেন, প্রধানমন্ত্রী যে কথা দেন তা রাখেন। পদ্মা সেতু নিয়ে বহু ষড়যন্ত্র হয়েছে। কিন্তু কোনো ষড়যন্ত্রই কাজে আসেনি। বিশ্বব্যাংক আমাদের টাকা দেয়নি, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী আমাদের নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু করে দেখিয়ে দিয়েছেন আমরাও পারি।
তিনি আরও বলেন, শেখ হাসিনার যোগ্য নেতৃত্বে দেশ আজ এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। সেই অগ্রযাত্রায় নতুন দ্বার উন্মোচিত হলো পদ্মা সেতুর মাধ্যমে। আমরা দক্ষিণাঞ্চলবাসী সৌভাগ্যবান। পদ্মা সেতুর কারণে ফরিদপুর, শরীয়তপুর ও মাদারীপুরবাসী অর্থনৈতিকভাবে আরও এগিয়ে যাবে। পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে শুধু দক্ষিণাঞ্চলের মানুষই নয়, দেশের বিভিন্ন স্থানের মানুষ এ সেতুর কারণে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হবে। ব্যবসা-বাণিজ্যের নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে এ সেতুর মাধ্যমে।
ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মাসুদ হোসেন বলেন, পদ্মা সেতু এখন আর স্বপ্ন নয়, বাস্তব। যারা এ সেতু নির্মাণ নিয়ে নানা মুখরোচক কথা বলে বেড়িয়েছেন তাদের মুখে চুনকালি মেখে দিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেখিয়ে দিয়েছেন তিনি যা উদ্যোগ নেন তা করেই ছাড়েন। এ সেতুর কারণে দক্ষিণাঞ্চলবাসী তাদের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন পেয়েছে। পদ্মা সেতুর কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যে নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে। এ অঞ্চলে মিল-কারখানা গড়ে উঠবে। ফলে ফরিদপুরের মানুষ অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে।
ফরিদপুরের ভাঙ্গা পৌরসভার মেয়র এএফএম ফয়েজ রেজা বলেন, পদ্মা সেতুর কারণে এ অঞ্চলের মানুষ অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি তাদের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটবে। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার কারণেই পদ্মা সেতুসহ এ অঞ্চলের নানা উন্নয়নমূলক কাজ হচ্ছে। আওয়ামী লীগ সরকার না থাকলে এ উন্নয়ন কোনোভাবেই সম্ভব হতো না।
ফরিদপুরের ভাঙ্গা বাজারের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী সাইফুল্লাহ শামীম বলেন, দীর্ঘদিন ধরে ফরিদপুরবাসী ছিল অবহেলিত। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কারণেই এ অঞ্চলে নানা উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড হচ্ছে। দেশের গৌরব পদ্মা সেতু এখন আর কোনো স্বপ্ন নয়, পদ্মা সেতু বাস্তব হিসেবে ধরা দিয়েছে। কেবল শেখ হাসিনার কারণেই এটি সম্ভব হয়েছে। আমরা ফরিদপুরবাসী প্রধানমন্ত্রীকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানাই। তার কারণেই আমরা উন্নয়নের পর উন্নয়ন পাচ্ছি।
বরিশাল অঞ্চলের অর্থনীতি চাঙ্গা হবে : পিছিয়ে পড়া দক্ষিণাঞ্চল এগিয়ে যাবে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে তাও আবার এই পদ্মা সেতুর মাধ্যমে। এতে করে বরিশাল ও পটুয়াখালী জেলার মানুষের অর্থনৈতিক চাকা আরও সচল হবে বলে ধারণা করছেন ব্যবসায়ীরা। সরকারের উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় পটুয়াখালীর পায়রা সেতুর কাজও ৭৫ ভাগ শেষ হয়েছে। আগামী ২০২১ সালের মধ্যে পায়রা সেতু দিয়ে যানবাহন চলাচল করবে। ভাবতেই যেন অবাক লাগে।
আর স্বপ্নের এ সেতু ধাপে ধাপে এমন এগিয়ে যাওয়ায় উচ্ছ্বসিত দক্ষিণাঞ্চল তথা বরিশালের মানুষ। বিশেষ করে সড়ক পথকে ঘিরে নানা জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়ে গেছে সাধারণ মানুষসহ পরিবহন সংশ্লিষ্টদের মধ্যে। এই প্রথমবারের মতো গোটা দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর সরাসরি সড়ক পথের সংযোগ স্থাপন হলো।
বরিশাল থেকে মাওয়া রুটে চলাচলকারী যাত্রীবাহী, পণ্যবাহী পরিবহনের চালক-মালিকরা বলছেন, সর্বশেষ স্প্যান বসানোয় পদ্মা সেতু এখন পুরোটাই দৃশ্যমান। আর এর মধ্য দিয়ে সেতুর বেশিরভাগ কাজও শেষ হয়েছে। এখন যে কাজ তা দেখতে দেখতে শেষ হয়ে যাবে। পদ্মা সেতু দিয়ে যানবাহন চলাচল শুরু হলে বরিশাল, পটুয়াখালী, বরগুনা, পিরোজপুর, ঝালকাঠি ও ভোলা থেকে ঢাকায় যেতে সময় কমে যাবে প্রায় দেড় থেকে ২ ঘণ্টা। আর যাত্রীসেবার মানও বাড়বে কয়েকগুণ।
পরিবহন মালিক ও চালকরা বলছেন, মাওয়া ফেরি ও সরু সড়কপথের কারণে এ অঞ্চলে বিলাসবহুল পরিবহন সংযোজন যারা এতদিন করতে পারেননি, তারা পদ্মা সেতু চালু হলেই বিনিয়োগ করবেন। আর এ বিনিয়োগকে সফল করে তুলতে এর পেছনে বিশেষ ভূমিকা রাখবে দক্ষিণাঞ্চলের পর্যটন শিল্প।
বরিশাল নগরীরের রূপাতলী বাস টার্মিনাল এলাকার পরিবহন চালক সোলায়মান বলেন, সমুদ্র সৈকত দেখতে ১২ থেকে ১৩ ঘণ্টা ব্যয় করে কষ্ট হলেও এখন মানুষ কক্সবাজার যাচ্ছেন। কিন্তু পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে পটুয়াখালীর কুয়াকাটার সমুদ্র সৈকতে ঢাকা থেকে যেতে সময় লাগবে মাত্র ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা। অর্থাৎ কক্সবাজার থেকে অর্ধেকেরও কম সময় লাগবে কুয়াকাটায় আসতে। আবার বরিশাল, পিরোজপুর ও ঝালকাঠির ভাসমান বাজার অর্থাৎ ফ্লোটিং মার্কেট কিংবা শাপলার বিল দেখতে ঢাকা থেকে আসতে তেমন একটা সময়ের প্রয়োজন হবে না।
বরিশাল জেলা বাস মালিক সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কিশোর কুমার দে বলেন, পদ্মা সেতু ছিল দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের প্রাণের দাবি। আর সেই দাবি বাস্তবায়নে কাজ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ফলে পদ্মা সেতু চালু হলে সড়কপথেও যাত্রীদের সেবার মান বাড়বে। সেই সঙ্গে বাস মালিক বা প্রতিষ্ঠানও এ অঞ্চলের জন্য নতুন করে বিনিয়োগ করবে।
ভোগান্তি থেকে মুক্তি মিলবে : পদ্মার এপারের বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার মানুষ বিভিন্ন স্বপ্ন দেখছে পদ্মা সেতুকে ঘিরে। তাদের মাঝে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা বিরাজ করছে। সেতুটি চালু হওয়ার পরপরই ভাগ্য বদলে যাবে এ অঞ্চলের বিভিন্ন শ্রেণির পেশাজীবীদের।
পদ্মা সেতু বাস্তবায়নে সেতুর এপারের মাদারীপুর ও ফরিদপুর অঞ্চলে ইতোমধ্যে বহুমুখী প্রকল্প নিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মপরিকল্পনা শুরু করে দিয়েছে। পদ্মা সেতুর দ্বার উন্মোচণের ফলে এ অঞ্চলের মানুষ তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা, বেকারত্ব ও শিল্প-কারখানা গড়ার ক্ষেত্রে নবোদ্যমে কাজ শুরু করে দিয়েছে।
সেতুর এপারে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণের ফলে নানামুখী সুবিধা যেমন শিক্ষাব্যবস্থা, দারিদ্র্য ও বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি, স্বাস্থ্যসেবা, গণযোগাযোগ ব্যবস্থা, অর্থনীতি ও পরিবহন সহজলভ্যতা ইত্যাদি বিষয়ে সুফল পাবে বলে আশা করছে।
এ নিয়ে সদরপুর উপজেলার বিভিন্ন শ্রেণির পেশাজীবীর সঙ্গে কথা হয়। মো. ফরিদুল ইসলাম সদরপুর বাজারের একজন ব্যবসায়ী। তিনি বলেন, আমরা বাজারের দোকানদাররা ঢাকার চকবাজার থেকে সপ্তাহের শনিবারে মোকাম করতাম। কারণ ঢাকা থেকে প্রতি সপ্তাহের শনিবার শুধু নদীযোগে তোতা মাঝির একটি ট্রলার আসত চন্দ্রপাড়া ঘাটে। দু-তিন দিন পর দোকানে সে পণ্য পেতাম। পদ্মা সেতুর কারণে আশা করি প্রতিদিনের মালামাল প্রতিদিন দোকানে বিভিন্ন ট্রান্সপোর্টের মাধ্যমে চলে আসবে।
কৃষক মো. আবুল বাশার জানান, ফরিদপুর জেলার মধ্যে কৃষিখ্যাত এলাকা সদরপুর উপজেলা। এ অঞ্চলের নানামুখী উৎপাদনকৃত সবজি রাজধানীতে বিক্রয় করা হয়। ফেরিঘাটের দুর্ভোগের কারণে অনেক সময় কাঁচা সবজি পচে যেত। সময়মতো বাজারজাত না করার কারণে ক্ষতির সম্মুখীন হতাম। পদ্মা সেতুর কারণে আমরা প্রতিদিনের সবজি রাজধানীতে পাঠাতে পারব। অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার স্বপ্ন দেখছি।