গুম করে জঙ্গি মামলা, বছরের পর বছর চলতো নির্যাতন

গুম করে রেখে দিতেন পুলিশ লাইনের গোপন বন্দিশালায়। এ সময় চালানো হতো শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। নির্যাতনের একপর্যায়ে আয়নাঘরে রাখা ব্যক্তিদের জড়ানো হতো ভুয়া জঙ্গি মামলায়। যাদের কারও কারও আজও সন্ধান পাওয়া যায়নি। নির্মম নির্যাতনের পর কাউকে সড়ক দুর্ঘটনা দেখিয়ে মেরে ফেলা হতো। পেট কেটে কারও লাশ ফেলে দেওয়া হতো নদীতে। চাঞ্চল্যকর এমন সব ঘটনায় এরই মধ্যে গুম কমিশন অব ইনকোয়ারিতে লিখিত অভিযোগ করেছেন একাধিক ভুক্তভোগী।
এছাড়া ওই সময় বগুড়া ও আশপাশের এলাকায় আতঙ্কের নাম ছিল অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আরিফুর রহমান মণ্ডল। এলাকার মানুষ আরিফ মণ্ডলের আয়নাঘরের ভয়াবহতার কথা জানলেও ভয়ে মুখ খুলতেন না।
তারা যুগান্তরকে জানান, গুম করে জঙ্গি মামলায় ফাঁসানোর নেতৃত্বে ছিলেন বগুড়ার তৎকালীন পুলিশ সুপার মো. আসাদুজ্জামান, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আরিফুর রহমান মণ্ডল ও মো. আব্দুল জলিল। এছাড়া গুম করা ব্যক্তিদের ওপর নির্মম নির্যাতন চালিয়ে জল্লাদের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতেন বগুড়া ডিবির তৎকালীন ইন্সপেক্টর আমিরুল, ইমরান মাহমুদ তুহিন, এসআই জুলহাস, মুজিবর, আলমগীর, এএসআই রাশেদ ও কনস্টেবল গোবিন্দসহ এই গ্রুপের অনেকে। ডিবিতে যারা ওই সময় আয়নাঘরের ‘অ্যাকশন গ্রুপ’ হিসাবে পরিচিত ছিলেন।
জানা গেছে, গুম হওয়া অনেককেই চাঁপাইনবাবগঞ্জের আলোচিত জঙ্গিবিরোধী অভিযান ‘অপারেশন ঈগল হান্ট’র মামলায় আসামি করা হয়। যারা ঘটনার বিষয়ে কিছুই জানতেন না বলে দাবি করেছেন। ২০১৭ সালের ২৬ এপ্রিল জঙ্গিবিরোধী অপারেশন ঈগল হান্ট অভিযান চালানো হয়। কিন্তু এ মামলায় যাদের আসামি করা হয় তাদের অনেককে তুলে নেওয়া হয় ঘটনার বেশ কিছুদিন আগে। পরে ফাঁসানো হয় জঙ্গি মামলায়। এছাড়া গুমের শিকার অনেকের কোনো সন্ধান পায়নি পরিবার।
বগুড়া পুলিশ লাইনে দায়িত্ব পালন করা একজন পুলিশ কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ‘আমি ওখানে যোগদানের পরই বন্দিদের দেখতে পাই। চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল তারা নিরপরাধ মানুষ। ২০১৭ সালে অন্তত ৩০ জন মানুষকে নেওয়া হয় সেখানে। তাদের ধরে নিয়ে আসার নেতৃত্বে ছিলেন এসপি আসাদুজ্জামান। সঙ্গে মূল দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আরিফ মন্ডলের সঙ্গে কাজ করতেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আব্দুল জলিল। তারা আটককৃতদের ওপর অমানবিক অত্যাচার চালাতেন। এছাড়া মাঝেমধ্যে টার্গেটকৃত ব্যক্তিদের নির্যাতনে হত্যার পর সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত বলে চালিয়ে দিতেন। মূলত রাতের অন্ধকারে রোড এক্সিডেন্ট দেখিয়ে মেরে ফেলা হতো। এমনকি হত্যার পর পেট কেটে নদীতে লাশ ফেলে দেওয়া হতো বলেও শুনেছি।’
ক্ষোভ প্রকাশ করে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘তারা মানুষ হত্যা করে এখন কীভাবে এসপির দায়িত্বে রয়েছেন? তাদের ফাঁসির দড়িতে ঝোলানো হোক।’
এ বিষয়ে গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের সদস্য নূর খান লিটন বলেন, বগুড়া পুলিশ লাইনের গোপন বন্দিশালার বিষয়ে আমাদের কাছে অভিযোগ এসেছে। বিষয়টি নিয়ে আমরা তদন্ত করছি। তবে তদন্তাধীন বিষয়ে কিছু বলা যাচ্ছে না। এর আগে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি জানান, সেখানে বিভিন্ন জায়গা থেকে বন্দিদের জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্যাতন করা হতো। এখানে অনেকের মৃত্যুর ঘটনাও ঘটতে পারে। গুমের শিকার একজন হাফিজুর রহমান হাফিজ। বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটের পার্বতীপুরে। ঢাকায় একটি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন হাফিজুর। ২০১৭ সালের ১৭ এপ্রিল কর্মস্থলে যাওয়ার পথে সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কয়েকজন সদস্য তাকে তুলে নিয়ে যান।
সেদিনের ঘটনা বর্ণনা করে হাফিজুর যুগান্তরকে বলেন, ওইদিন রাজধানীর বায়তুল মোকাররম এলাকা থেকে বগুড়া জেলা পুলিশের তৎকালীন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আরিফ মণ্ডলের নেতৃত্বে সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কয়েকজন সদস্য তুলে নিয়ে যায়। পরে একটি মাইক্রোবাসে তুলে চোখ বেঁধে ফেলে, কয়েক ঘণ্টা পর রাখা হয় একটি গোপন কক্ষে। কয়েকদিন পর সেখানে খাবারের প্যাকেটের গায়ে লেখা দেখে বুঝতে পারি আমাকে বগুড়া পুলিশ লাইনে আনা হয়েছে। বগুড়া পুলিশ লাইনে গুম থাকা অবস্থায় কোনো কথা বলতে গেলেই চালানো হতো নির্যাতন। পরে ডিউটিরত পুলিশ সদস্যদের মারফতে গুমের অবস্থানের বিষয়টি পুরোপুরি নিশ্চিত হই। সেখানে আরিফ মণ্ডল আমাকে জঙ্গিসংশ্লিষ্টতার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করেন। আমাকে গুম করার সময় যে কয়েকজন পুলিশ সদস্য ছিলেন, তাদের মধ্যে আরিফ মণ্ডলকেও চিনতে পারি। বগুড়া ডিবির ওসি (ডিবি) আমিরুল, ডিবির ওসি তদন্ত ইমরান আহমেদ তুহিন এবং এসআই জুলহাসসহ গুম করার সময় উপস্থিত কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে বগুড়া পুলিশ লাইনের আয়নাঘরে দেখেও চিনতে পারি। পরে ডিউটিরত পুলিশ সদস্যের মাধ্যমে আরিফ মণ্ডলসহ বাকিদের নাম-পরিচয় নিশ্চিত হই।
হাফিজুর বলেন, আমার সংশ্লিষ্টতা না পেয়ে বগুড়ার পুলিশ সদস্যরা বলেন, ‘তোকে ছেড়ে দিলে তো সব ফাঁস করে দিবি, এজন্য একটা ছোট মামলা দিয়ে ছেড়ে দিব।’ প্রায় ৮২ দিন গুম রাখার পর বগুড়া থেকে আমাকে চাঁপাইনবাবগঞ্জে আনা হয়। পরে মধ্যরাতে একটি আমবাগানে জঙ্গি গ্রেফতারের নাটক সাজায় বগুড়ার টিম। পরে বুঝতে পারি ঈগল হান্টের মামলায় আমাকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে।
হাফিজুরের প্রশ্ন-অপারেশন ঈগল হান্ট অভিযান চালানো হয় ২০১৭ সালের ২৬ এপ্রিল। আর আমাকে তুলে নিয়ে যায় অপারেশনের ৯ দিন আগে। সব মিলিয়ে প্রায় ৩ মাসের মতো গুম রাখা হয়। গুম হওয়ার পর ওই সময়ই আমার পরিবারের পক্ষ থেকে নিখোঁজ ডাইরি করা হয়। এমনকি অপহরণ মামলাও করে পরিবার। পত্রিকায় নিখোঁজের সংবাদও প্রকাশ করা হয়। অথচ নাটক সাজিয়ে পুলিশ আমাকে গুম করে জঙ্গির তকমা লাগায়।
ভুক্তভোগীদের আরেকজন চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর থানার রহমতপাড়া গ্রামের আল-আমিন। বাবা পুলিশের উপ-পরিদর্শক। চাকরির সুবাদে পরিবারের সঙ্গে থাকতেন রাজশাহীতে। সে সময় রাজশাহী কলেজের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন আল-আমিন। তিনি বলেন, কলেজে যাওয়ার পথে সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কয়েকজন সদস্য তাকে সাদা হায়েস মাইক্রোবাসে তুলে নেয়। পরে কালো কাপড় দিয়ে মুখ বেঁধে নেওয়া হয় একটি ভবনে। সেখানে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের কাছ থেকে জানতে পারেন তাকে বগুড়া পুলিশ লাইনে রাখা হয়েছে। প্রতিবাদ করলে ক্রসফায়ারের ভয় দেখানো হয়। প্রায় ৫ মাস গুম রেখে তাকেও জড়ানো হয় জঙ্গিবিরোধী অভিযান ঈগল হান্টের মামলায়।
এরইমধ্যে গুম কমিশনে আল-আমিনও অভিযোগ করেছেন। ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে আল-আমিন জানান, তাকে গুমের ঘটনায় বগুড়ার তৎকালীন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আরিফুর রহমান মণ্ডল, বগুড়া ডিবির তৎকালীন ওসি তুহিন, এসআই জুলহাস, এসআই মজিবুর, এসআই আলমগীর, এএসআই রাসেল এবং কনস্টেবল সালাম ছিলেন। এদের পরিচয় সে সময় ডিউটিরত কয়েকজন পুলিশ সদস্যের কাছ থেকেই তিনি জেনেছেন। পরে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা পুলিশের কাছে তাকে হস্তান্তর করে। পরে ঈগল হান্টের মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয় আল-আমিনকেও।
আল-আমিন বলেন, ‘তিনি যে পুলিশ কর্মকর্তার ছেলে সেটি জানতেন না অভিযানসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। পরে জানার পরও তাদের মন গলেনি, কোনো সংশ্লিষ্টতা না থাকার পরও আমাকে ছাড়তেও ভয় পাচ্ছিলেন বগুড়ার পুলিশ সদস্যরা। কারণ ঘটনা ফাঁস হওয়ার ভয়ে নিজেদের বাঁচাতে উলটো ঈগল হান্ট মামলায় জড়ানো হয়। নানাভাবে ভয়ভীতি দেখিয়ে আমাকে চাপে রাখেন। নিরপরাধ হয়েও এখনো জঙ্গির তকমা লেগে আছে।’
শুধু হাফিজুর রহমান কিংবা আল-আমিন নয়, চাঁপাইনবাবগঞ্জের মোস্তফা জামাল ও শেরপুরের আবুল কাশেমসহ অসংখ্য মানুষকে বগুড়া পুলিশ লাইনের আয়নাঘরে রাখা হয়েছিল। তাদের অনেককেই অপারেশন ঈগল হান্টের মামলার আসামি করা হয়। আবার অনেকে এখনো ফিরে আসেননি। এদের মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জের দুই ভাই মিজানুর রহমান ও রেজাউল করিম রয়েছেন। তাদের আরেক ভাই সেতাউর রহমান বলেন, ২০১৬ সালে গুমের পর এখনো ফিরে আসেনি তারা। ছোট ভাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রেজাউল করিম বগুড়ায় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আরিফ মন্ডলের আয়নাঘরে ছিলেন। মিজানুর রহমানকে ছাড়াতে ছোট ভাই রেজাউল ৯ লাখ টাকা দিয়েছিল পুলিশকে। টাকা নিয়ে তাকে না ছেড়ে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে আরও ১১ লাখ টাকা দাবি করে। এতে ক্ষোভ প্রকাশ করায় রেজাউলকে গুম করা হয়। দুই সন্তানকে হারানোর শোকে পরে স্ট্রোক করে মা মারা যান, বাবাও এখন অসুস্থ।
২০১৭ সালের ২৬ এপ্রিল চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জের ত্রিমোহনী-শিবনগর গ্রামে। জঙ্গিবিরোধী অভিযান ‘অপারেশন ঈগল হান্ট’ পরিচালনা করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। যাতে অংশ নেয় সিটিটিসি, সোয়াত, র্যাব ও পুলিশ। অভিযান শেষে চারজনের মরদেহ ও অস্ত্রসহ বিস্ফোরক উদ্ধার দেখায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তবে স্থানীয় বাসিন্দা, প্রত্যক্ষদর্শী ও সাক্ষীরা জানান, ওই অভিযানে বাইরে থেকে ৩ জনের মরদেহ ঘটনাস্থলে আনা হয়, পরে মরদেহগুলো উদ্ধার দেখায় অভিযানসংশ্লিষ্টরা। নিহতদের মধ্যে একজনের দেহ তরতাজা থাকলেও, বাকি ৩টি ছিল পচা ও দুর্গন্ধময়। ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক, অ্যাম্বুলেন্স চালক ও স্থানীয়রাও একই বক্তব্য দেন। এতদিন ভয়ে মুখ খুলতে না পারলেও ৭ বছর পর সামনে আসছে আলোচিত ‘অপারেশন ঈগল হান্ট’ অভিযান। স্থানীয়রা বলছেন, জঙ্গি নাটক সাজিয়ে নিরপরাধ মানুষকে ফাঁসানো হয় স্পর্শকাতর মামলায়। অস্ত্র ও বিস্ফোরক উদ্ধার দেখানো হলেও সেটি ছিল সাজানো।।
-যুগান্তর