বিদ্রুপের শিকার সেই ছেলেটিই হতে যাচ্ছেন বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্প থেকে অনেক এগিয়ে রয়েছেন জো বাইডেন। তার বিজয় ঘোষণা এখন শুধু আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী বছরই তিনি আমেরিকার ৪৬তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেবেন। তার পুরো নাম জোসেফ রবিনেট বাইডেন জুনিয়র। তবে সংক্ষিপ্ত জো বাইডেন নামে পরিচিত তিনি।
ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সদাসয় বাইডেন দেশটিতে দীর্ঘদিন ধরে অ্যাটর্নি হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এরপর নেমে পড়েন রাজনীতির ময়দানে। নিজ রাজ্য ডেলাওয়ারে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে সিনেটর ছিলেন তিনি। সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার আমলে ৪৭তম ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন বাইডেন।
জো বাইডেনের জন্ম ১৯৪২ সালের ২০ নভেম্বর পেনসিলভানিয়ার স্ক্রানটনে। চার ভাই-বোনের মধ্যে বাইডেন সবার বড়। তিনি স্ক্রানটন, নিউ ক্যাসল কাউন্টি ও ডেলাওয়ার জেলায় বেড়ে ওঠেন। তার বাবা জোসেফ রবিনেট বাইডেন সিনিয়র। আর তার মা ক্যাথরিন ইউজেনিয়া ফিনেগান একজন আইরিশ বংশোদ্ভুত মার্কিন নাগরিক।
স্ক্রানটনে সেন্ট পালস এলিমেন্টরি স্কুলে পড়াশোনা করেন বাইডেন। ১৩ বছর বয়সে পরিবারসহ ডেলাওয়ারে আসেন তিনি। ছোটবেলা থেকে বাচনশক্তিতে সমস্যা ছিল বাইডেনের। এজন্য স্কুলে সহপাঠীরা প্রায়ই তাকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করত। সেন্ট হেলেনা স্কুল, বার্চমেরে অ্যাকাডেমির শিক্ষার্থী হিসেবে শিক্ষকদের নজর কাড়েন রোগাটে, ছিপছিপে কিশোর বাইডেন। ছোটবেলায় কথা বলতে গিয়ে আটকে যাওয়া শিশু বাইডেন আজ মার্কিন রাজনীতির অন্যতম আইকন।
জো বাইডেন ডেলাওয়ার ইউনিভার্সিটিতে ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পড়াশোনা করেন। পরে তিনি সিরাকিউজ ইউনিভার্সিটি থেকে আইনের ওপর ডিগ্রি নেন। বাইডেন ১৯৬৬ সালে সিরাকিউজ ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় নিলিয়া হান্টারকে বিয়ে করেন। তাদের ঘরে তিন সন্তান রয়েছেন। তারা হলেন- জোসেফ আর ‘বিউ’ বাইডেন, রবার্ট হান্টার ও নাওমি ক্রিস্টিনা। ১৯৭২ সালে বড়দিনের আগে ক্রিসমাস ট্রি কিনতে গিয়ে ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় নিলিয়া নিহত হন। তার মেয়ে নাওমিও দুর্ঘটনায় মারা যান।
স্ত্রী নিলিয়াকে বাইডেন বলেছিলেন, ৩০ বছর বয়সের মধ্যে তার স্বপ্ন সিনেটর হওয়ার। সিনেটর হওয়ার পরের লক্ষ্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়া। তিনি তার লক্ষ্যে অবিচল ছিলেন। নিলিয়াকে হারানোর ১ বছরের মাথায় ১৯৭৩ সালে বাইডেন জিল ট্রেসি জ্যাকবকে বিয়ে করেন। তাদের ঘরে অ্যাশলে ব্লেজার নামে এক কন্যাসন্তান রয়েছে।
জো বাইডেন ১৯৭০ সালে ডেলাওয়ারের নিউ ক্যাসল কাউন্টির কাউন্সিলম্যান নির্বাচিত হন। এরপর তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ৩০ বছর বয়সের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর হওয়ার স্বপ্নপূরণ হয় তার। ১৯৭২ সালের নভেম্বরে তৎকালীন জনপ্রিয় রিপাবলিকান সিনেটর স্যালেব বগসের বিপক্ষে ডেমোক্র্যাটিক দল থেকে প্রার্থী হন তিনি। এতে জয়ের মধ্য দিয়ে মাত্র ৩০ বছর বয়সে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে কম বয়সি পঞ্চম সিনেটর নির্বাচিত হন।
ডেলাওয়ার থেকে মোট ছয়বার সিনেটর নির্বাচিত হন জো। সিনেটের বিচার কমিটিতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা আইনসহ যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকটি আইন প্রণয়ন করেন তিনি। ২০০৭ সালে আবার নির্বাচনে দাঁড়ান বাইডেন। তখন বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট হন এবং রানিংমেট হিসেবে বেছে নেন বাইডেনকে। ২০০৯-১৭ সাল পর্যন্ত তিনি ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেন।
২০১৫ সালে বাইডেন ফের প্রিয়জন হারান। তার বড় ছেলে বো বাইডেন মস্তিষ্কের ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তার মৃত্যুতে ভেঙে পড়েন জো বাইডেন। ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির মনোনয়ন পাওয়ার আগেই তিনি সরে যান। ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক জীবনে নানা উত্থান-পতনের পর ঘুরে দাঁড়ান জো বাইডেন।
জো বাইডেন দীর্ঘদিন মার্কিন সিনেটের পররাষ্ট্র সম্পর্ক বিষয়ক কমিটিতে কাজ করেছেন। সিনেটের এই কমিটির সভাপতি হিসেবে ২০১২ সালের অক্টোবরে আমেরিকার রিপাবলিকান প্রেসিডেন্টের ইরাক যুদ্ধে যাওয়ার বিষয়টিকে অনুমোদন দেওয়ার সিদ্ধান্ত ছিল তার ওপর। এর ১১ বছর আগে উপসাগরীয় যুদ্ধের প্রাক্কালে প্রেসিডেন্ট জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশকে সাদ্দাম হোসেনের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অনুমোদনের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিলেন বাইডেন। বাইডেনের হুঁশিয়ারি সত্বেও উপসাগরীয় যুদ্ধের পক্ষে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং ওই যুদ্ধে বেশ কয়েকজন মার্কিন সেনা মারা যায়। এরপর থেকে বাইডেনকে পররাষ্ট্র ও জাতীয় প্রতিরক্ষা নীতির ক্ষেত্রে দুর্বলচিত্ত বলে তুলে ধরা শুরু হয়।
ওই ভোট নিয়ে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হওয়ার পরবর্তী কয়েক বছর বাইডেন আন্তর্জাতিক বিষয়ে কট্টর অবস্থান দেখাতে শুরু করেন। এর ফলস্বরূপ তিনি বলকান গৃহযুদ্ধে আমেরিকান অবস্থান, ইরাকে বোমা হামলা এবং আফগানিস্তানে দখলদারিত্ব কায়েমের প্রতি তার সমর্থন প্রকাশ করেন। প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ ইরাকের কাছে ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্র রয়েছে, এই অভিযোগে যখন ইরাকে নতুন করে যুদ্ধ শুরুর প্রস্তাব করেন, তখন বাইডেন তাতে জোরালো সমর্থন দিয়েছিলেন। ইরাক যুদ্ধের পর তিনি বামপন্থার দিকে ঝুঁকে পড়েন। তিনি ইরাকে আমেরিকান সৈন্য সংখ্যা বৃদ্ধির বিরোধিতা করেন এবং সেখান থেকে সেনা প্রত্যাহারের আহ্বান জানান।
জো বাইডেন ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে আফগানিস্তানে মার্কিন বাহিনী জোরদার করার এবং ওসামা বিন লাদেনের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর বিপক্ষে পরামর্শ দেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হওয়ার লড়াইয়ে নামার ঘোষণা দেওয়ার পর তিনি ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধে সৌদি আরবের প্রতি আমেরিকার সমর্থন বন্ধ করার পক্ষেও মত তুলে ধরেন।