নীতি-নির্ধাকরদের ছলচাতুরী বনাম সাংবাদিকদের অসহায়ত্ব
রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে অবদমিত করে রাখার জন্য পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশে নানা চাতুর্যপূর্ণ কৌশলের আশ্রয় নেয়ার বিষয় কমবেশি সকলেই অবহিত। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। প্রতিপক্ষকে প্রতিযোগিতার মাঠ থেকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্যে সরকার তাদের বিরুদ্ধে মামলার আশ্রয় নিয়ে কারারুদ্ধ করে রাখে। অন্তরীণ হওয়া কিংবা ‘ক্রসফায়ারের’ আশ্রয় নিয়ে চিরতরে নির্মূল করার এন্তার দৃষ্টান্ত রয়েছে এদেশে। এজন্যে এককভাবে কোনো সরকারকে দায়বদ্ধ করা যাবে না। দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের চরিত্রের মধ্যে এই বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। এজন্য পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলো বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশসমূহ, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের এই ধরনের রাজনীতির ঘোরতর বিরোধিতা করে থাকে। সরকার যাতে নাগরিকদের এভাবে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত না করে সে জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাদের প্রতিশ্রুত অর্থ সহায়তা কিংবা তৈরি পোশাক শিল্প রপ্তানির ক্ষেত্রে বিদ্যমান কর রেয়াত সুবিধা বাতিল করার হুমকিও দেয়। কিন্তু তাতে অনেক সময়ই ফল পাওয়া যায় না। যুক্তরাষ্ট্র বারবার মানবাধিকার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। বাংলাদেশে মানবাধিকার ব্যাপকভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে- এসব অভিযোগ তারা ক্রমাগতভাবে করেই যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র প্রতিবছর মানবাধিকার অনুশীলন সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রণয়ন ও প্রকাশ করে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই প্রতিবেদন তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে এবং ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস আগে থেকেই অনানুষ্ঠানিকভাবে এই প্রতিবেদন প্রকাশের সময় সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকদের অবগত করে। দেশের দৈনিক পত্রিকাগুলো এই রিপোর্ট যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ করে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে যথারীতি এই রিপোর্টকে ‘মনগড়া’, ‘একপেশে’, ‘পক্ষপাতদুষ্ট’ ইত্যাদি শব্দ সংযুক্ত করে প্রতিবাদ জানানো হয়। এই প্রতিবেদনে নাগরিকদের অধিকার, রাজনৈতিক পরিস্থিতি, কারখানায় শ্রমিকদের অধিকার ইত্যাদি বিষয় তুলে ধরা হয়। সর্বজনীন মানবাধিকার সংক্রান্ত ঘোষণাপত্র এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক চুক্তির নিরিখে নাগরিকদের এসব অধিকার কতটা ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে তা এই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়। ১৯৬১ সালের বৈদেশিক সহায়তা আইন এবং ১৯৭৪ সালের বাণিজ্য সংক্রান্ত আইনের আওতায় যেসব দেশ সহায়তা গ্রহণ করে এবং যেসব দেশ জাতিসংঘের সদস্য তাদের উপরই এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই প্রতিবেদন মার্কিন কংগ্রেসের কাছে পেশ করে। এসব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করার পরই তা প্রকাশ করা হয়।
আমি অফিসে ফিরে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য সামনে এনে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি, বিরোধী রাজনৈতিক দলের অবস্থান, অভিযোগ- নেপথ্যের এসব বিষয় তুলে ধরে একটি রিপোর্ট করি। সিঙ্গাপুরে ডেস্কের সংশ্লিষ্ট সম্পাদক বারবার মার্কিন কর্মকর্তার বক্তব্য কি জানতে চাচ্ছিলেন। আমি তাকে জানালাম যে, বৈঠক শেষে তিনি কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট সম্পাদক আমাকে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসে যোগাযোগ করে এ প্রসঙ্গে তাদের বক্তব্য জানার জন্য চাপ দিতে থাকেন। আমি বারবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলাম। এর পর দীর্ঘক্ষণ ডেস্ক থেকে আর কোনো সাড়া পেলাম না এবং ধরে নিলাম এই রিপোর্ট খারিজ করে দেয়া হয়েছে। পরের দিন ডেস্কের সংশ্লিষ্ট সম্পাদক আমার রিপোর্টটি সম্পাদনা শেষে আমার কাছে ফেরত পাঠিয়ে দেন ভালোভাবে দেখার জন্যে। সঙ্গে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মন্তব্য সংবলিত সূচনা বক্তব্য। স্পষ্টতই বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যকে অস্বীকার করা হয়েছে। ওয়াশিংটনে রয়টার্সের যে সাংবাদিক পররাষ্ট্র দপ্তরের সংবাদ সংগ্রহ করেন তাকে এই রিপোর্টে যুক্ত করে বক্তব্য নেয়া হয়েছে। রয়টার্সের বিশ্বব্যাপী কার্যক্রম চলমান আছে বলেই এ ধরনের সংবেদনশীল রিপোর্টে উভয়পক্ষের বক্তব্য যুক্ত করা সম্ভব। সংশ্লিষ্ট সম্পাদক বললেন, ‘বৈঠকে উপস্থিত উভয়পক্ষের বক্তব্য ছাড়া এ ধরনের রিপোর্ট পাঠকদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে না। তাই আমাদের রিপোর্টকে বিশ্বাসযোগ্য করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে।’
-মানবজমিন