ঐক্য যেন বাকশাল না হয়: মঈন খান
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান বলেছেন, ঐক্য করতে গিয়ে যদি আবার বাকশাল করে ফেলি, তাহলে কিন্তু সেই ঐক্য কাজ হবে না। তাই সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে, ঐক্য যেন বাকশালে রূপান্তর না হয়।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে বাংলাদেশের নদী-পানির অধিকার আন্দোলনের পুরোধা, আন্তর্জাতিক ফারাক্কা কমিটির নেতা আতিকুর রহমান সালুর স্মরণে আয়োজিত সভায় তিনি এসব কথা বলেন। আন্তর্জাতিক ফারাক্কা কমিটি এ সভার আয়োজন করে।
জাতীয় ঐক্য গঠনে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের বৈঠক নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এ সদস্য বলেন, ঐক্য অবশ্যই প্রয়োজন জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে। এতে কারো কোনো দ্বিমত থাকতে পারে না। কিন্তু এই প্রশ্নে সতর্ক করে দিতে চাই, ইংরেজিতে একটা কথা আছে- ইউনিটি ইন ডাইভারসিটি। আমরা ঐক্য করতে গিয়ে যদি আবার বাকশাল করে ফেলি, তাহলে কিন্তু সেই ঐক্যে কাজ হবে না। আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। ডেমোক্রেসি মুখে বলা সহজ কিন্তু বাস্তবে রূপদান করা কিন্তু এত সহজ না।
মঈন খান বলেন, আপনারা নতুন প্রজন্মের কথা বলেন। কোথায় নতুন প্রজন্ম? বিগত ১৫-২০ বছর বা দুই দশক ধরে আমাদের নতুন প্রজন্মের কেউ ভোট দিতে পেরেছে? পারেনি তো।
অন্তর্বর্তী সরকারকে উদ্দেশ করে বিএনপির এই নেতা বলেন, আজকে সংস্কারের কথা বলছেন খুব ভালো কথা। সংস্কার তো লাগবেই। কিছু মনে করবেন না, আমি স্পষ্ট ভাষায় বলে দেই, আমরা যতক্ষণ পর্যন্ত না নিজেরা নিজেদের সংস্কার না করবো, ততক্ষণ কোনো সংস্কারই কাজে আসবে না।
মঈন খান বলেন, একটি নাম আতিকুর রহমান সালু, একটি প্রতিবাদ আতিকুর রহমান সালু।… এই মানুষটিকে কেন এতদিন আমরা স্মরণ করিনি। আজ তার মৃত্যুর এক বছর পর আমরা এখানে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছি। দি ডেমোক্রেটিক গভর্নমেন্ট অব ইস্ট বেঙ্গলের ঘোষণাপত্র পাঠ করেছিলেন সালু। ইতিহাস সবসময় মানুষের ওপর সুবিচার করে না।পরবর্তী জীবনে তিনি নতুন করে একটি ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। ২০০৫ সালের ৫ মে দ্বিতীয় ফারাক্কা লংমার্চ করেছিলেন। তার সমগ্র জীবন আবর্তিত হয়েছে এই দেশের কল্যাণে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের স্বাধীনতা ও ভোট দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা অর্থ, বিত্ত, বৈভব ও ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষাকে ছাড়িয়ে যায়।… প্রায় দুই দশক ধরে আমাদের নতুন প্রজন্ম ভোট দিতে পারেনি। এটাই সত্য। দুঃখের বিষয় হচ্ছে আমরা বাংলাদেশের নেতারা সেই সত্যে বিশ্বাস না করে অর্থ, বিত্ত, বৈভব, ক্ষমতা, অবস্থান (পজিশন), মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী, প্রেসিডেন্ট – এগুলোর পেছনে ছুটি।
মঈন খান বলেন, হাজার হাজার জীবনের বিনিময়ে জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মাধ্যমে স্বৈরাচারকে দেশ থেকে হটানো হয়েছে। কিন্তু তার অর্থ এটা নয় যে, দেশে গণতন্ত্র ফেরত এসেছে। এই সত্যকে আমাদের উপলব্ধি করতে হবে।
বিএনপির এই নেতা বলেন, আমাদের গণতন্ত্র রূপান্তরের মাত্র একটি ধাপ আমরা অতিক্রম করেছি, তা হচ্ছে স্বৈরাচারের বিদায়। আরও কঠিন দুইটি ধাপ রয়েছে। দ্বিতীয় ধাপ হলো অত্যাবশ্যকীয় সংস্কার সম্পাদন করে এ দেশে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন দিয়ে এদেশের কোটি কোটি মানুষের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করা। তৃতীয় ধাপ হলো নির্বাচিত মানুষের কাছে অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক ক্ষমতা হস্তান্তর করা। একটি জনগণের সরকার আসতে হবে। যারা একটি স্বাধীন সংসদ গঠন করবে, যারা সত্যিকার অর্থে প্রতিনিধিত্ব করবে, ডামি বা ভুয়া সংসদ নয়। এ গুরুদায়িত্ব এসে পড়েছে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ওপরে। সে কারণেই আমরা বলছি এই সরকারকে আমরা সর্বাত্মক সহযোগিতা দিচ্ছি। আমরা কোনো অবস্থাতেই চাই না তারা ব্যর্থ হোক। কেননা, এই সরকার ব্যর্থ হলে তা শুধু তাদের ব্যর্থতা হবে না, সেটা হবে সমগ্র জাতির ব্যর্থতা।
তিনি বলেন, সামাজিকভাবে তারা কিভাবে এই গুরুদায়িত্ব পালন করবে। আমি নীতিগতভাবে তিনটি কথা বলবো।তিনটি অস্ত্র আমাদের হাতে রয়েছে। এক রাজনীতি, দুই কূটনীতি, তিন গণমাধ্যম ও তথ্যপ্রযুক্তি। আমি বিশ্বাস করি যদি বাংলাদেশের মানুষ ও বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই তিনটি অস্ত্র সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারে তাহলে বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হবে। শুধু ঐক্য নয়, ঐক্য ও বৈচিত্র্যে আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যাব। এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
বিএনপির এই প্রবীণ নেতা বলেন, ফারাক্কা বাঁধের গেট প্রথম যখন খোলা হয়েছিল, তখন বলা হয়েছিল পরীক্ষামূলক উদ্বোধন হচ্ছে। দুঃখ ও শঙ্কার সঙ্গে আমি উল্লেখ করতে চাই, সেই পরীক্ষামূলক উদ্বোধন দশকের পর দশক ধরে চলছে। পরিবেশগত আগ্রাসন সবসময় সরাসরি চোখে দেখা যায় না। কেননা, এর প্রভাব পড়তে সময় লাগে। ফারাক্কা ও অন্যান্য ৫৬টি অভিন্ন নদীর পানির অধিকার আমরা পাইনি। ফারাক্কার কারণে আমাদের পানির অধিকার বিঘ্নিত হয়েছে। ফারাক্কার প্রভাবে শুধু আমাদের নাব্যতা, কৃষিকাজ ও ফসলের উৎপাদনই বিঘ্নিত হচ্ছে না, নদীর লবণাক্ততাও বেড়েছে বিগত দশকগুলো ধরে। এই পরিবেশগত বিপর্যয় রোধ না করতে পারলে আমাদের বংশধররা বাংলাদেশ থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। এই সমস্যার সমাধান বাংলাদেশ একা করতে পারবে না। এর দায়িত্ব আমাদের বন্ধু রাষ্ট্রের ওপরেও বর্তায়। আমরা সবার সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্কে চলতে চাই। আমাদের পররাষ্ট্রনীতি সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব।
স্মরণসভায় আরও বক্তৃতা করেন জাতীয় পার্টির (জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, আইএফসি সভাপতি অধ্যাপক জসীম উদ্দিন আহমেদ, আইএফসি চেয়ারম্যান সৈয়দ টিপু সুলতান, বিএফইউজে মহাসচিব কাদের গনি চৌধুরী, জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক আইয়ুব ভূঁইয়া প্রমুখ।
-যুগান্তর