প্রিমিয়ার ব্যাংকের ৩ হাজার কোটি টাকার ভুয়া ঋণের সঙ্গে জড়িত সালাম মুর্শেদী
আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুস সালাম মুর্শেদীর বিরুদ্ধে প্রিমিয়ার ব্যাংকের ৩ হাজার কোটি টাকার ভুয়া ঋণসহ অসংখ্য অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে। এ ব্যপারে দুর্নীতি দমন কমিশনে অভিযোগ করা হলেও কোনো কাজ হয়নি, বলে জানান ভুক্তভোগীরা। অভিযোগ রয়েছে, হাসিনা পরিবারের সদস্যদের ঘনিষ্ঠলোক পরিচয়ে দেশের ক্রীড়া ও আর্থিক খাতসহ বিভিন্ন জায়গায় ভাগ বসিয়ে অল্পদিনেই করছেন শত শত কোটি টাকার দুর্নীতি। তবে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তার দুর্নীতির বিষয়গুলো আবারো নতুন করে সামনে এসেছে। শুধু তাই নয়; ছাত্র আন্দোলন প্রতিহত করতেও আব্দুস সালাম মুর্শেদী অর্থায়ন করেছিলেন বলে অভিযোগ রছেছে।
দুদক সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের ২৩ জুন দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার সিনিয়র স্পেশাল জজ মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেনের আদালত প্রিমিয়ার ব্যাংকের পরিচালক সালাম মুর্শেদীর ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ৪ কর্মকর্তা, প্রিমিয়ার ব্যাংকের অতিরিক্ত মহাপরিচালক ও নারায়ণগঞ্জ শাখার ব্যবস্থাপক শহিদ হাসান মল্লিক, ভাইস প্রেসিডেন্ট ও নারায়ণগঞ্জ শাখার ২য় কর্মকর্তা মুশফিকুল আলম, ফরেন এক্সচেঞ্জ ইনচার্জ দীপক কুমার দেবনাথ ও ক্রেডিট ইনচার্জ মোহাম্মদ মেহেদী হাসান সরকারকে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেন। দুদকের পাবলিক প্রসিকিউটর মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
দুদকের উপপরিচালক ও অনুসন্ধান টিমের প্রধান মোস্তাফিজুর রহমান তখন এই আবেদনে উল্লেখ করেন, ব্যাংকটির নারায়ণগঞ্জ ও প্রধান কার্যালয়ের কতিপয় বিভাগের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ব্যাংকের প্রভাবশালী পরিচালকদের আদেশে ব্যাক টু ব্যাক এলসি সুবিধার আড়ালে জাল-জালিয়াতি, বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে ৪৩টি সন্দেহভাজন তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা ভুয়া ঋণ মঞ্জুর করে আত্মসাতসহ মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের সম্পৃক্ত ধারায় অপরাধ করার অভিযোগ অনুসন্ধানাধীন আছে।
আবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, এই অভিযোগের বিষয়ে ৩ সদস্য বিশিষ্ট অনুসন্ধানকারী টিম গঠন করা হয়েছে। ব্যবসায়ী মহলের অনেকেই বলছেন, রপ্তানিকারকদের সংগঠন-এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হিসেবে এই কেলেঙ্কারিতে সালাম মুর্শেদী ও তার মেয়ে বিজিএমইএ’র পরিচালক শেহরীন সালাম এর যোগসাজশ রয়েছে। জানা যায়, আওয়ামী লীগের প্রতি রাজনৈতিক আনুগত্য নিয়ে ২০১৮ সালের আগস্টে খুলনা-৪ আসনের উপনির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য হন সালাম মুর্শেদী। এরপর ২০১৮ ও ২০২৪ এ জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের এমপি হন তিনি। তার এক ভাইরাল হওয়া বক্তব্যের ভিডিওতে দেখা যায় তিনি বলছেন, একমাত্র তারই ক্ষমতা আছে শেখ পরিবারের একজন প্রভাবশালী সাংসদের কাছে গিয়ে ফাইল স্বাক্ষর করে আনার। তার সন্তানেরা ১০ কোটি টাকার গাড়িতে চড়েন এমন দম্ভোক্তিও করেন তিনি। কর ফাঁকির অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
২০২৪ এর নির্বাচনে হলফনামায় দেখা গেছে, খুলনা-৪ আসনের আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়া সংসদ সদস্য আব্দুস সালাম মুর্শেদীর গত পাঁচ বছরে তার সম্পদ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩৭ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। এ ছাড়া তার স্ত্রীর ১৮ কোটি ৩৫ লাখ টাকার এবং নির্ভরশীলদের ২৪ কোটি ৯১ লাখ টাকার সম্পদ রয়েছে। অথচ ২০১৮ সালে তার ওপর নির্ভরশীলদের সম্পদ ছিল এক কোটি ৩৩ লাখ টাকার। এই হিসেব অনুযায়ী পাঁচ বছরে তা ১৮ গুণ বেড়েছে। বাফুফের সিনিয়র সহসভাপতি হিসেবে দেশের ক্রীড়াখাতে কলঙ্ক শীর্ষ দুর্নীতিবাজ ব্যক্তিদের একজন হিসেবে সমালোচনা আছে মুর্শেদীর। সরকার পতনের ৩ দিন পরই সুবিধাবাদী সালাম মুর্শেদী অবস্থা বুঝে ৮ আগস্ট পদত্যাগ করেন।
সালাম মুর্শেদী বাফুফে সিনিয়র সহসভাপতি পদে ছিলেন ২০০৮ সাল থেকে। সভাপতির পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদ সিনিয়র সহসভাপতি ছাড়াও সালাম মুর্শেদী বাফুফের অর্থ কমিটি ও রেফারিজ কমিটির প্রধানও ছিলেন। এই দুটি পদ থেকেও তিনি পদত্যাগ করেছেন। এর আগে আবদুস সালাম মুর্শেদীকে ১০ হাজার সুইস ফ্রাঁ (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১৩ লাখ টাকা) জরিমানা করে বিশ্ব ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থা ফিফা। মূলত বাফুফের অর্থ কমিটির প্রধান হিসেবে ফিফা প্রদত্ত অর্থের অনিয়মের কারণেই এই জরিমানা করা হয় তাকে।
মুর্শেদী আওয়ামী লীগ আমলে সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হন জালিয়াত ও দুর্নীতি করে রাজউকের যোগসাজশে গুলশানে সরকারি জায়গা দখল করে বাড়ি করে। যা দুদকের তদন্তে উঠে আসে। তবে অজ্ঞাত কারণে আসামি হননি মুর্শেদী দুদকের মামলায়। অভিযোগ আছে-দুদকে ব্যবহার করেছিলেন তার রাজনৈতিক প্রভাব। হাইকোর্ট এ বছর গুলশানের বাড়ি গণপূর্তকে হস্তান্তর করার আদেশ দিয়ে রায় দিলেও মুর্শেদী চেম্বার আদালত থেকে স্থিতি অবস্থা নিয়ে বাড়ি দখলে রেখেছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, আবদুস সালাম মুর্শেদী রাজধানীর উত্তরায় রোডের পাশে সিয়াম টাওয়ারের মালিক। ইমারত নির্মাণ বিধিমালা আইন ভঙ্গ করে ১৫ তলা বাণিজ্যিক এই ভবনের উচ্চতা সিভিল এভিয়েশনের নির্ধারিত উচ্চতার চেয়ে প্রায় ১০ মিটার (৯ দশমিক ৭৬) বেশি। যা বিধিমালার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। নকশা বহির্ভূত ভাবে ভবনের সেটব্যাকে নির্মাণ করা হয়েছে ব্যাংকের এটিএম বুথ। রাজউকের নকশা অনুযায়ী, সিয়াম টাওয়ারের ডানে বামে ৮ ফিট- সামনে ৫ ফিট পিছনে ১০ ফিট পরিমাণ জায়গা ছাড়ার কথা থাকলেও ১ ইঞ্চি জায়গাও ছাড়েনি সালাম মুর্শেদীর মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান শারমিন হোল্ডিংস। কথা তার কোনটিই রাখা হয়নি।
রাজউক অনুমোদিত নকশায় টপ ফ্লোর অফিস হিসেবে দেখান থাকলেও সেখানে নিয়ম বহির্ভূতভাবে করা হয়েছে বাণিজ্যিক রেস্টুরেন্ট। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের কাছ থেকে ভবনের নিরাপত্তা ছাড়পত্র দীর্ঘদিন ধরে নবায়ন করা হয়নি। এনভয় টেক্সটাইলের ব্যবস্থপনা পরিচালক থাকালে আব্দুস সালাম মুর্শেদীর কারখানার নামে শুল্কমুক্ত সুবিধায় কেন্দ্রীয় শীততাপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র আমাদানি করে তা স্থাপন করেন নিজের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান সিয়াম টাওয়ার। এই নিয়ে শুল্ক ফাঁকির মামলা হলেও ক্ষমতাশালী এমপি হওয়ায় এতদিন পার পেয়েছেন সালাম মুর্শেদী। এনভয় টেক্সটাইলের ব্যবস্থপনা পরিচালক পদে থাকা নিয়ে এক মামলায় আদালত রায়ের পর্যবেক্ষনে বলে মুর্শেদী প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক হওয়ার অযোগ্য। কারণ তিনি কোম্পানী আইন লঙ্ঘন ও শুল্ক আইনের অপব্যহার করেছেন। তবে এতো সব অভিযোগের বিষয়ে মন্তব্য জানতে কথা বলতে চাইলে তার ব্যবহৃত দুটি মোবাইল নম্বরই বন্ধ পাওয়া গেছে। এমনকি গুলশানে তার বাড়ির নিরাপত্তা কর্মীরাও তার ব্যাপারে কোনো তথ্য জানাতে পারেননি।
-ইনকিলাব