উত্তরাখণ্ডে মাদ্রাসা ভাঙ্গা নিয়ে সহিংসতায় ২ জনের মৃত্যু

ভারতের উত্তরাখণ্ড রাজ্যের হলদওয়ানিতে বৃহস্পতিবার রাত থেকে ছড়িয়ে পড়া সহিংসতায় অন্তত দুজন মারা গেছেন, আহত হয়েছেন একশোরও বেশি মানুষ। বেআইনিভাবে নির্মিত একটি মাদ্রাসা ভেঙ্গে দিতে গেলে সরকারি কর্মীদের ওপরে হামলা দিয়ে সংঘর্ষ শুরু হয়।
এর আগে অবশ্য প্রশাসন জানিয়েছিল যে সংঘর্ষে চার জন মারা গেছেন।
নিহতদের পরিচয় এখনও প্রকাশ করেনি পুলিশ-প্রশাসন।
প্রশাসন এটাও বলছে যে জবরদখল করা জমিটিতে কোনও নথিবদ্ধ মাদ্রাসা ছিল না।হলদওয়ানিতে কারফিউ জারি হয়েছে, আর দেখা মাত্রই গুলি চালানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
মাদ্রাসাটি উচ্ছেদ করতে গিয়েছিলেন পৌরসভার কর্মী ও পুলিশ সদস্যরা।
নৈনিতালের জেলা শাসক বন্দনা সিং জানিয়েছেন, স্থানীয় থানায় হামলা চালিয়ে উত্তেজিত জনতা বেশ কয়েকটি গাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে।
সহিংসতায় আহতদের মধ্যে এক ডজন সাংবাদিকসহ বেশ কয়েকজন পুলিশ ও বেসামরিক প্রশাসনের সদস্যও রয়েছেন।
নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতির কারণে রাতের মধ্যেই কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর চারটি ব্যাটেলিয়নসহ আশেপাশের জেলাগুলি থেকে পুলিশ বাহিনীকে হলদওয়ানিতে ডাকা হয়।
এলাকায় ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বন্ধ রয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিও।
গোটা রাজ্যেই সতর্কতা জারি করা হয়েছে।
নৈনিতালের সিনিয়র পুলিশ সুপারিন্টেডেন্ট প্রহ্লাদ মীনা বলেছেন যে মাদ্রাসাটি সরকারি জমিতে অবৈধভাবে নির্মিত হয়েছিল এবং এটি ভেঙে ফেলার নোটিশ আগেই দেওয়া হয়েছিল।
তবে জেলা শাসক বন্দনা সিং সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, “এটি সাম্প্রদায়িক সহিংসতা নয়। কোনও একটি ধর্মের মানুষ যে পুলিশের ওপরে হামলা চালিয়েছেন, এমনটা নয়। রাজ্য প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে এখানে।“

ঘটনার শুরু যেভাবে
বিজেপি শাসিত উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী পুষ্কর সিং ধামি জানিয়েছেন আদালতের নির্দেশে ওখানে জবরদখল সরাতে গিয়েছিল কর্মকর্তা ও পুলিশের একটি দল। কিছু ‘সমাজ বিরোধী’ সেখানে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধায়। বাড়তি কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী ও রাজ্য পুলিশ সেখানে পাঠানো হচ্ছে।
শান্তি বজায় রাখার আবেদন করেছেন মুখ্যমন্ত্রী, একই সঙ্গে দেখামাত্র গুলির নির্দেশও দিয়েছেন তিনি।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মাদ্রাসা ভাঙার কাজ শুরু হতেই বিপুল সংখ্যক মানুষ রাস্তায় নেমে আসেন এবং সংঘর্ষ শুরু হয়। এরপরই শুরু হয় পাথর ছোঁড়া। পেট্রোল বোমাও ছোঁড়া হয়, বহু গাড়ি, মোটরসাইকেল জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।
পুলিশও পাল্টা ব্যবস্থা নিতে শুরু করে।
কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বনভুলপুরা থানাতেও হামলা চালায় উত্তেজিত জনতা এবং পুলিশের বেশ কয়েকটি গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়।
বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাসের শেল ফাটায়।
“আগুন নেভাতে জল-কামান ব্যবহার করা হলেও জনতা সেখান থেকে সরে যায়নি। অন্যদিকে ভিড়ের ভেতর থেকে গুলি চালানোর খবর পাওয়া গেছে। যে গুলিতে মানুষের মৃত্যু হয়েছে, সেটা জনতার দিক থেকে এসেছিল, নাকি সেটা পুলিশের গুলি ছিল, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানান নৈনিতালের জেলা শাসক বন্দনা সিং।
জেলাশাসক বলেন, “পুলিশ ও প্রশাসন কাউকে প্ররোচনা দেয়নি, কাউকে হত্যা করেনি বা কোনোভাবে কারও ক্ষতি করার চেষ্টা করেনি।
এলাকায় কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে এবং শীঘ্রই নিরাপত্তা বাহিনী পৌঁছাবে বলে আশা করা হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে আশপাশের জেলাগুলো থেকেও অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।

বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে জবরদখল সরাতে শুরু করে প্রশাসন
জবরদখল উচ্ছেদ অভিযান
বন্দনা সিং বলেন, “এটি কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় যেখানে ইচ্ছাকৃতভাবে কোনও সম্পত্তিকে লক্ষ্য করে জবরদখল সরানো হচ্ছিল।
তিনি বলেন, “গত ১৫-২০ দিন ধরে হলদওয়ানির বিভিন্ন এলাকায় পৌরসভার জমি থেকে জবরদখল সরানোর জন্য অভিযান চালানো হচ্ছিল। এ বিষয়ে হাইকোর্টের নির্দেশেও আছে।”
“একটি ফাঁকা জমির ওপরে দুটি কাঠামো নির্মিত হয়েছে। এগুলি কোনও ধর্মীয় কাঠামো হিসাবে স্বীকৃত নয়। কেউ কেউ এটিকে মাদ্রাসা বলেন, আবার কেউ কেউ বলেন এখানে একসময়ে নামাজ পড়া হত। কিন্তু কোনও আইনি নথিতে এগুলির অস্তিত্ব নেই। এই এলাকাটিকে ‘মালিক কা বাগিচা’ বলা হলেও নথিপত্রে এই নামটির কোনও উল্লেখ পাওয়া যায় না”, বলেন মিজ সিং
জেলা শাসক বলছেন, এই হামলার ঘটনা পূর্ব পরিকল্পিতই ছিল।
তার কথায়, “আগে থেকেই বাড়ির ছাদে ইট-পাথর জড়ো করে রাখা হয়েছিল। উত্তেজিত জনতা ওই বেআইনি স্থাপনাটিকে রক্ষা করার যে বিশেষ চেষ্টা করছিলেন, তা নয়। তাদের লক্ষ্য ছিল সরকারি কর্মকর্তা আর সরকারি সম্পত্তিগুলির প্রতি।”

কী বলছেন স্থানীয়রা?
বনভুলপুরার বাসিন্দা জাফর সিদ্দিকি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস সংবাদপত্রকে জানিয়েছেন, আবদুল মালিক নামে এক ব্যক্তি এই অন্য একজনের কাছ থেকে জমিটি লিজ নিয়ে মসজিদটি বানিয়েছিলেন।
তিনি বলছেন, “গত চার-পাঁচ দিন ধরে পুলিশ এই এলাকায় আসা যাওয়া করছিল। তারা বলছিল যে মাদ্রাসা এবং মসজিদ ভেঙ্গে দেওয়া হবে। বৃহস্পতিবার সকালে প্রশাসনের লোকজন একটি বুলডোজার মেশিন নিয়ে এখানে পৌঁছায়। বিকেল পাঁচটা-ছয়টার দিকে এলাকায় গিয়ে দেখি পাথর ছোঁড়া হয়েছে, কয়েকটি গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে।”
তার কথায়, “কিছু লোক থানায় গিয়ে ভাঙচুর করেছে। এই পুরো ঘটনা ৩০ থেকে ৪০ মিনিট ধরে চলে। পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে, তাতে আমি তো বাড়িতে তালা বন্ধ করে রয়েছি।”

আহত সাংবাদিকরাও
বনভুলপুরার ঘটনায় এক ডজনেরও বেশি সাংবাদিক আহত হয়েছেন।
স্থানীয় একটি নিউজ পোর্টাল হলদওয়ানি লাইভের সম্পাদক মি. পঙ্কজ বিবিসিকে বলেছেন, তিনি এবং বাকি সাংবাদিকরা পুলিশ ও প্রশাসনের একটি দলের সঙ্গে জবরদখল উচ্ছেদের খবর সংগ্রহ করতে গিয়েছিলেন।
তখনই কয়েকটি বাড়ির ছাদ থেকে তাদের লক্ষ্য করে পাথর ছোঁড়া শুরু হয়।
মি. পঙ্কজ বলেন, এক ডজনেরও বেশি সাংবাদিক আহত হয়েছেন। তার নিজের স্কুটার এবং বেশ কয়েকটি সাংবাদিকের গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।-বিবিসি
এবিসিবি নিউজ/এমআই