Type to search

জাতীয় বাংলাদেশ রাজনীতি

নির্বাচনে অংশ নেয়া ‘কিংস পার্টি’গুলো এখন কোথায়?

পৌরসভা নির্বাচন-এবিসিবি নিউজ

বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ‘কিংস পার্টি’ হিসেবে পরিচিত যে সব রাজনৈতিক দল সক্রিয় হয়ে উঠেছিল, নির্বাচনের পর সেই রাজনৈতিক দলগুলো প্রায় নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। দলগুলোর নেতারা অবশ্য বলছেন যে, তারা তাদের নিয়মিত কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন এবং দল পুনর্গঠনের চেষ্টা করছেন।

আর রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচনকে সুষ্ঠু দেখানোর জন্য সরকারের নির্দেশে উত্থান হওয়া এসব দলের নির্বাচন পরবর্তী সময়ে ‘মৃত্যু’ হওয়াটাই স্বাভাবিক। আর এ কারণেই খুব একটা সাড়াশব্দ নেই দলগুলোর।

নির্বাচনের আগে আগে অপরিচিত কয়েকটি রাজনৈতিক দল বেশ সক্রিয় হয়ে উঠেছিল। খুব অল্প সময়ের মধ্যে এসব দলকে নিবন্ধনও দেয়া হয়েছিল। বিএনপির অনেক দলছুট নেতাও এসব দলে বড় পদে যোগ দিয়েছিলেন।

রাজধানীর অভিজাত এলাকায় কার্যালয় নিয়ে বেশ জোরেশোরেই দলীয় কার্যক্রম শুরু করেছিল এসব দল। রাজনৈতিক সমালোচকরা এসব রাজনৈতিক দলকে ‘কিংস পার্টি’ হিসেবে অভিহিত করেন।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তৃণমূল বিএনপি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন-বিএনএম, এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি-বিএসপি-কে ‘কিংস পার্টি’ হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে। তবে এই দলগুলো বরাবরই এই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।

এই দলগুলো এমন এক সময়ে নির্বাচনে অংশ নেয়ার কথা জানায় যখন দেশের অন্যতম বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপি নির্বাচন বর্জন করে। একই সাথে নির্বাচনকে সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ আন্তর্জাতিক চাপ ছিল।

নির্বাচনের আগে নিবন্ধন পাওয়া নতুন এই দলগুলো নির্বাচনে অংশও নিলেও জয় তো দূরের কথা, বেশির ভাগ প্রার্থীই জামানত পর্যন্ত হারিয়েছেন।

এসব দলের নেতারা বলছেন, নির্বাচন থেকে তাদের মূল পাওয়া আসলে দলের পরিচিতি, জয়লাভ নয়। আর এখন দলকে সুসংগঠিত করাই তাদের মূল লক্ষ্য।

তৃণমূল বিএনপির প্রথম কাউন্সিলে দলটিতে যোগ দেন বিএনপির দলছুট দুই নেতা শমসের মবিন চৌধুরী এবং তৈমুর আলম খন্দকার।

তৃণমূল বিএনপির প্রথম কাউন্সিলে দলটিতে যোগ দেন বিএনপির দলছুট দুই নেতা শমসের মবিন চৌধুরী এবং তৈমুর আলম খন্দকার।

‘দুই মাসের দল’

২০১৫ সালে তৃণমূল বিএনপি নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠিত হলেও দলটি নিবন্ধন পায় ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে। গত বছরের ১৯শে সেপ্টেম্বর দলটির প্রথম কাউন্সিলে যোগ দেন বিএনপির দলছুট দুই নেতা শমসের মবিন চৌধুরী এবং তৈমুর আলম খন্দকার।

দলটির প্রতীক সোনালী আঁশ। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৩৩টি আসনে প্রার্থী দেয় তারা।

তবে কোনও আসনেই এই দলের কোনও প্রার্থী জয়ী হতে পারেনি। উল্টো বেশির ভাগ প্রার্থীরই জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে।

তৃণমূল বিএনপির মহাসচিব তৈমুর আলম খন্দকার বলেন, এই নির্বাচনে অংশ নেয়ার মাধ্যমে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন কেমন হয় সে বিষয়ে একটা অভিজ্ঞতা হয়েছে তাদের।

তিনি বলেন বাংলাদেশে চল্লিশটিরও বেশি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশ দলের নাম ও প্রতীক তেমন কেউ জানে না। তবে তাদের দলের নাম, নেতাদের নাম ও প্রতীক দেশের মানুষ জেনেছে – এটা তাদের একটি অর্জন।

“দলটি হইল আমাদের দুই মাসের দল। নির্বাচন কমিশন আমাদের দলটাকে নিবন্ধন দেয় নাই। আমরা সুপ্রিম কোর্টে যুদ্ধ কইরা নিবন্ধন পাইছি।”

নির্বাচনে আসার আগে সরকারের কাছ থেকে কোনও আশ্বাস পাননি উল্লেখ করে তিনি বলেন, সরকারের বিরুদ্ধে তারা নির্বাচনে গিয়েছেন।

এর আগের নির্বাচনগুলোতে নানা ধরনের অনিয়মের অভিযোগ থাকলেও সরকার গঠন, তাদের ক্ষমতায় থাকা এবং বিদেশি সমর্থন- কোনোটিই ঠেকানো যায়নি বলে উল্লেখ করেন তিনি। তাই এবার ক্ষমতাসীন দল বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যাতে জিততে না পারে তা নিশ্চিত করতেই নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন তারা।

“সরকারকে আমরা ব্ল্যাংক চেক দিতে চাই নাই। আমরা চাই নাই যে, সরকার শুয়ে শুয়ে পাস করুক। এবার আমাদের সাথে নির্বাচন করতে গিয়ে সরকারকে অনেক বেগ পাইতে হইছে। সরকারকেও মাঠে নামতে হইছে।”

‘কিংস পার্টি’ হওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন তিনি। “সরকারের লগে আমরা আঁতাত করি নাই। সরকারের লগে যদি থাকতাম আমরাও (আসন) পাইতাম।”

আপাতত দলের কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়া, এবং জেলা-উপজেলা পর্যায়ে সংগঠন গড়ে তোলা এবং পরবর্তী সময়ে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়েছেন তিনি।

কেন্দ্রীয় কার্যালয় এখনও পল্টনের তোপখানা রোডেই রয়েছে। তবে একই এলাকায় ভালো আরেকটি নতুন কার্যালয়ের কথা চিন্তা করছেন তারা।

তিনি বলেন, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির মতো দল ক্ষমতায় থাকার কারণে সেগুলো বিস্তার লাভ করতে বা বড় দল হতে পেরেছে। তৃণমূল বিএনপি এখনও সেই সুযোগ পায়নি।

নিয়েছে, তাতে সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও শেষ মুহূর্তে প্রশাসনের লোকজন একমুখী আচরণ করেছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

দল নিষ্ক্রিয় হয়ে যাচ্ছে কি না এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, তাদের দলটিই নতুন। এখনো তারা দলের কার্যালয়ে মূলত যাওয়া-আসা করছেন। দলটি ছোট হওয়ার কারণে সেগুলো বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মতো জাঁকজমকপূর্ণ নয়। ছোট অন্য দলগুলোর মতোই তারা রয়েছেন এবং তারা ভবিষ্যতে দল গঠনে কাজ করবেন।

তিনি জানান, কেন্দ্রীয় কার্যালয় আছে এবং এটা থাকবে। বিভাগীয় পর্যায়ে কার্যালয় স্থাপনের চেষ্টা করা হবে।

‘কিংস পার্টি’র অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, “কিংস পার্টি যদি আমরা হতাম তাহলে কিছু অন্তত নমিনেশন, আমরা নির্বাচনে বিজয় লাভ করার জন্য একটা আন্ডারস্ট্যান্ডিং থাকতো। নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী বা কারো সাথে আমাদের কোনও বৈঠক হয় নাই। এবং আমরা জিতবো, এই কয়টা সিট পাবো এরকম ভাগাভাগি হয় নাই।”

তিনি জানান, সরকারের সাথে তাদের কোনও সমঝোতা নাই।

‘কিংস পাটি’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া আরেকটি রাজনৈতিক দল হলো বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি। এই দলটি ৭৯টি আসনে প্রার্থী দিয়েছিল। কোনও প্রার্থীই জয়লাভ করেননি।

এই দলটির সাথে যোগাযোগ করেও প্রাথমিকভাবে কোনও মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

নির্বাচনে এসব দলের কোন প্রার্থী জয় পাননি। নির্বাচনে এসব দলের কোনও প্রার্থী জয় পাননি।

‘আমি বিএনএম-এর নেতাও না’

বিএনএম প্রায় ৫৪টি আসনে প্রার্থী দিয়েছিল। এর মধ্যে শুধুমাত্র একটি আসনে প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়নি। বাকি সব আসনেই ভোট টানতে না পারার কারণে দলটির প্রার্থীদের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে।

নির্বাচন কমিশনের নিয়ম অনুযায়ী, একটি আসনে যত ভোট থাকে কোনও প্রার্থী যদি তার আট ভাগের এক ভাগ ভোট না পান তাহলে তার জামানত বাজেয়াপ্ত হয়।

কক্সবাজার-২ আসনের বিএনএম এর প্রার্থী মোহাম্মদ শরীফ বাদশা নির্বাচনে জয় না পেলেও তার জামানত বাজেয়াপ্ত হয়নি।

তিনি বলেন, এর পেছনে কাজ করেছে তার আগের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা এবং পরিচিতি। এর আগে তিনি মহেশখালী উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। যার কারণে এলাকায় তার জনপ্রিয়তা ছিল।

মি. বাদশা বলেন, বিএনএম থেকে মনোনয়ন নিয়ে তিনি নির্বাচন করেছিলেন। তিনি আশা করেছিলেন যে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে। কিন্তু সেটি হয়নি। ওই আসনে সরকারের ছাড় দেওয়ারও আশ্বাস ছিল বলে তিনি জানিয়েছেন।

“নির্বাচনের দুই দিন আগে (শুনছি) সরকার নাকি সিটগুলো ছাড়তেছে না, এটা আমাকে বিভিন্ন স্থান থেকে বলছে যে সরকার সিট ছাড়তেছে না। না ছাড়লে যা হয়, হয়ে গেছে আর কী।”

দল হিসেবে বিএনএম এর কাছ থেকে প্রত্যাশা কী, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “আমি বিএনএম এর নেতাও না।”

তিনি বলেন, এই দলটিতে যোগ দেয়ার উদ্দেশ্যই ছিল মনোনয়ন নেওয়া। তাই এবারই প্রথম এই দলে যোগ দিয়েছেন তিনি।

“আমি বিএনএম-এ গেছি প্রথম নমিনেশনটা নেওয়ার জন্য।”

মি. বাদশা জানান, নির্বাচনের পর দলের নেতাদের সাথে এখনও দেখা হয়নি তার। দেখা করার পর তিনি সবার সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবেন যে তিনি এই দলে থাকবেন কিনা।

মাঠ পর্যায়ে বিএনএম-এর নেতৃবৃন্দের বিষয়েও তেমন কোনও তথ্য নেই তার কাছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদরাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ

‘স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে’

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘কিংস পার্টি’ বা হঠাৎ করে সক্রিয় হয়ে উঠা এসব রাজনৈতিক দলগুলো আসলে ‘পুতুল দল’ হিসেবে কাজ করে। সরকার যেভাবে চায় দলগুলো ঠিক সেভাবেই আচরণ করে।

লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, নির্বাচনের মাঠে নামানোর জন্য এসব দলকে তড়িঘড়ি করে গঠন করা হয়েছে এবং নির্বাচন কমিশনও তাদেরকে দল হিসেবে নিবন্ধন দিয়েছে।

তার বক্তব্য, নির্বাচন কমিশন সরকারের নির্দেশে সরকারেরই একটি অঙ্গসংগঠন হিসেবে কাজ করেছে। তা না হলে এসব দলের নিবন্ধন পাওয়ার কথা নয়।

তিনি বলেন, “সরকারের নিম্নমানের স্থূল কৌশল ছিল নির্বাচনকে সামনে রেখে এই দলগুলোর উত্থান।”

“আর নির্বাচন যেহেতু হয়ে গেছে তাই এগুলোর স্বাভাবিক মৃত্যু হবে। যেভাবে বুদবুদের মতো ভেসে উঠেছিল, আবার মিলিয়ে যাবে।”

নানা ধরনের লোভ দেখিয়ে এবং সুযোগসুবিধা দিয়ে এসব দলকে নির্বাচনে নিয়ে আসা হয় বলে মনে করেন তিনি।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রাজনীতিতে এদের কোনও অবস্থান থাকে না। এরা এর আগে হয়তো নানা ধরনের দলে ছিল।

“এরা যে নির্বাচনটা করেছে গণতন্ত্রের প্রতি আস্থা বা ভালোবাসার কারণে নয়। এরা করেছে লোভে পড়ে। এর পেছনে লেনদেনের ইতিহাস থাকাটাও অস্বাভাবিক নয়। অতীতেও আমরা এমনটা দেখেছি”, বলছেন মহিউদ্দিন আহমদ।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকার বিএনপিকে ভাঙার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। পরে তেমন শক্ত কোনও রাজনৈতিক অবস্থান নেই, নিষ্ক্রিয় ছিল বা তেমন জনসমর্থন নেই, এমন কিছু লোককে নির্বাচনে নামিয়ে সেটিকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছিল।

কিন্তু ভোটারদের উপস্থিতি কম থাকার কারণে সেটি খুব একটা সফল হয়নি।

মি. আহমদ বলেন, “নির্বাচন যেহেতু আওয়ামী লীগের একতরফা ছিল, তাই এদের জামানত বাজেয়াপ্ত হওয়াটাও স্বাভাবিক ছিল। কারণ এদের কেউই আসলে জয় লাভ করার মতো প্রার্থী ছিলেন না।”-বিবিসি

এবিসিবি/এমআই

Translate »