Type to search

Lead Story আন্তর্জাতিক সম্পাদকীয় ও মতামত

প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সফর প্রত্যাখ্যান ভারতের কূটনৈতিক ধাক্কা

এম কে ভদ্রকুমার:

যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক ও শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা গুরপতওয়ান্ত সিং পান্নুনকে নিউইয়র্কে হত্যাচেষ্টার মতো স্পর্শকাতর ঘটনা এবং এর প্রভাবের বিষয়টি তাৎক্ষণিক অতিরঞ্জিত করা বা ছোট করে দেখা সহজ। এটি অনেকটা ঈশ্বরের ক্রোধ থেকে বাঁচতে উটপাখির মতো বালুতে মাথা গোঁজার মতো বিষয়। দিল্লিভিত্তিক থিঙ্কট্যাঙ্কাররা যদিও অনুমান করছেন, পান্নুনের ঘটনা ‘ভারত-মার্কিন সম্পর্কের ক্ষেত্রে নিছক সাধারণ বিষয় হয়ে থাকবে।’ ভালোটা নিশ্চয়ই স্বস্তিদায়ক। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এ থিঙ্কট্যাঙ্কাররাই তালেবানকে পরাস্ত করার জন্য ভারতকে সামরিক হস্তক্ষেপের সুপারিশ করেছিল।

ভারতীয় থিঙ্কট্যাঙ্কাররা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আইন কতটা শক্তিশালী, তা বুঝতে পারছেন না। সেখানে এমনকি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ছেলে হান্টার বাইডেনকেও ছাড়া হবে না। গত শুক্রবার হান্টারের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়, সেগুলো প্রমাণ হলে তার ১৭ বছরের জেল হতে পারে। একজন পাবলিক প্রসিকিউটর যেভাবে আমেরিকার মাটিতে একটি বিদেশি সরকার কর্তৃক অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের আনুষ্ঠানিক অভিযোগ এনেছেন, মার্কিন বিচারব্যবস্থায় সেটি গুরুতর ঘটনা। যেহেতু পান্নুন মামলায় ভারতের মতো শক্তিশালী বিদেশি শক্তি জড়িত থাকার কথা বলা হচ্ছে, যে কিনা যুক্তরাষ্ট্রের ‘অপরিহার্য অংশীদার’, সে জন্য অভিযোগটি স্টেট ডিপার্টমেন্ট এবং হোয়াইট হাউসের মাধ্যমে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার ব্যাপার আছে।

প্রজাতন্ত্র দিবসে (২৬ জানুয়ারি, ২০২৪) ভারত মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে প্রধান অতিথি হওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। কিন্তু অপ্রত্যাশিত হলেও সত্য, তিনি ভারতীয়দের আমন্ত্রণ রক্ষা না করার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন। গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনী বছরে বাইডেন তাঁর সুনাম ঝুঁকিতে ফেলতে চাইছেন না। কারণ ভারতের বিষয়টি খুব ঝামেলাপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। বস্তুত বাইডেনকে আমন্ত্রণ জানানোর ক্ষেত্রে ভারত সরকারের একটা কারণ আছে। সেটা হলো, ভ্যাঙ্কুভারে জুন মাসে শিখ কর্মী হত্যার ঘটনায় ভারতীয়দের জড়িত থাকার কানাডার অভিযোগটি হোয়াইট হাউস ‘সমন্বয়’ করছিল।

পান্নুনের ঘটনায় যা বোঝা যাচ্ছে, তা বলা চলে নিমজ্জিত হিমশৈলের চূড়ামাত্র। আদালতে শুনানি শুরু হওয়ার পর সংকটের মাত্রাটা বোঝা যাবে, যদি ৫২ বছর বয়সী সন্দেহভাজন নিখিল গুপ্তের বিষয়টি সামনে আসে। চেক রিপাবলিক প্রজাতন্ত্রের প্রাগ থেকে যুক্তরাষ্ট্র তার প্রত্যর্পণ চাইছে। সম্প্রতি ইন্টারসেপ্ট ম্যাগাজিনের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এমনটিই বলা হয়েছে। প্রশ্ন হলো, এটা কীভাবে সম্ভব? ভারতের সরকারি মুখপাত্র যদিও বলেছেন, ম্যাগাজিনটি ‘পাকিস্তানি গোয়েন্দাদের দ্বারা পরিচালিত ভুয়া বয়ানের জন্য বিখ্যাত।’

অথচ ইন্টারসেপ্ট ম্যাগাজিনটি প্রায় এক দশক আগে আমেরিকার বিখ্যাত বিলিয়নেয়ার-জনহিতৈষী পিয়েরে ওমিডিয়ার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি জীবদ্দশায় তাঁর সম্পদের বেশির ভাগ অংশ দান করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তিনি দালাই লামার অনুসারী। সে জন্য ইন্টারসেপ্টকে আইএসআইর মদদপুষ্ট বলে ভারতের বক্তব্য সংশোধন করা উচিত।

আমি তখন পশ্চিম জার্মানির বনে আমাদের দূতাবাসের কাউন্সিলর হিসেবে কাজ করি। তখন আমাদের রাষ্ট্রদূত ডিএস কামতেকার আমাকে একটি খবরের ব্যাপারে ডেকে পাঠান। খবরটি শ্রীলঙ্কায় ইন্ডিয়ান পিস কিপিং ফোর্স বা আইপিকেএফের মোতায়েনবিষয়ক। কামতেকার ছিলেন অসাধারণ বুদ্ধিমান। তিনি ভারতের সিদ্ধান্তের বিষয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করেন। আমি মাত্রই কলম্বোতে আমার ৩ বছরের অ্যাসাইনমেন্ট শেষ করেছি। আমি অকপটে তাঁকে বলেছিলাম, সিদ্ধান্তটি মূর্খতাপূর্ণ। যাই হোক, জার্মান কর্মকর্তাদের ঠিক সেই বিষয়টি জানিয়েছি, যা দিল্লি চায়।

ইন্টারসেপ্টের প্রতিবেদনে যে অংশটি কেবল সংবেদনশীল ছিল, তা ভারতের কথিত ‘বৈশ্বিক গুপ্তহত্যা কর্মসূচি’ সম্পর্কে আলোচনা। এটা বিশ্বাস করা কঠিন যে, দিল্লি ইসরায়েলের পদাঙ্ক অনুসরণ করছে। কিন্তু এর পর ইন্টারসেপ্ট ইউনাইটেড স্টেটস ইনস্টিটিউট অব পিসের (ইএসআইপি) ড্যানিয়েল এস মার্কির সাক্ষাৎকার তুলে ধরেছে, যা রেডিফে প্রকাশ হয়েছে: ‘অভিযোগ (পান্নুনের ক্ষেত্রে) বিশ্বাস করার জোরালো কারণ হলো, ভারতীয় নিরাপত্তা কর্মকর্তারা এসব অপারেশন পরিচালনা করছিলেন এবং অর্থায়ন করছিলেন। যদি এটি সত্য হয়, তবে এটি ভারতীয় রাষ্ট্রীয় নীতি পরিবর্তনের কারণ বলে মনে হচ্ছে।

যদিও এটি ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকারের অবস্থানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, আমি এই কার্যকলাপে ভারতের শীর্ষ নেতাদের স্পষ্ট সমর্থনের বিষয়টি অনুমান করতে অনিচ্ছুক। আমরা হয়তো কখনোই সে ঘটনাগুলো জানতে পারব না।’ এখন সেটিই ডিনামাইটের মতো বিস্ফোরক মন্তব্য। মার্কি সতর্কতার সঙ্গে শব্দ চয়ন করেছেন এবং এটি একটি লিখিত সাক্ষাৎকার ছিল। এটা বিশ্বাস করার কারণ হলো, যুক্তরাষ্ট্র প্রাথমিকভাবে এটা মনে করেছে, ‘ভারতীয় ব্যবস্থা’ প্রবাসী শিখ ভিন্নমতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে হত্যামূলক প্রচারণা চালিয়েছে এবং পান্নুন পর্বটি এর একটি অংশ। মনে রাখতে হবে, ইউএসআইপির এমন সংঘাত সমাধানের অভিজ্ঞতা রয়েছে, যেখানে অফিস কিংবা অফিসের বাইরের লোকজনের হাত থাকে।

প্রশ্ন হলো, ভারত কীভাবে এ ধরনের অপ্রমাণিত অভিযোগ এবং বিষাক্ত বক্তব্য মোকাবিলা করবে? সাধারণ মিথের বিপরীতে বললে, উট পাখি বিপদ অনুভব করলে বা ভয় পেলে কেবল বালুতে তার মাথা গুঁজে দেয় না, বরং এটি মাটিতে পড়ে যায় এবং মাটির সঙ্গে মিশে যাওয়ার চেষ্টা করে। ভারত তা-ই করছে বলেই মনে হচ্ছে। তাতে কি শেষ রক্ষা হবে? ঈগল কিন্তু নিষ্ঠুর শিকারি।

 

এম কে ভদ্রকুমার: ভারতের সাবেক কূটনীতিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক; ইন্ডিয়ান পাঞ্চলাইন থেকে সংক্ষেপিত

 

এবিসিবি/এমআই

Translate »