অযোধ্যায় বাবরি মসজিদের জায়গায় রামমন্দির নির্মাণ উদ্বোধন করলেন মোদী
ভারতের অযোধ্যায় যেখানে প্রায় ৫০০ বছর পুরনো বাবরি মসজিদ ছিল ১৯৯২ সালের ৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত, সেই জায়গাতেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বুধবার রামমন্দির নির্মানের সূচনা করেছেন।
ধর্মীয় অনুষ্ঠানের শেষে মি. মোদী এক ভাষণ শুরুই করেন রামায়ণের একটি পংক্তি উদ্ধৃত করে। তিনি বলেন, “ভগবান রামের কাজ না করলে আমার শান্তি কিসে হবে?”
“রামলালা [হিন্দুদের কাছে ভগবান রামের ছোট বয়সের রূপকে রামলালা বলা হয়] অনেকদিন ধরেই একটি অস্থায়ী তাঁবুতে থাকছেন। কয়েক শতাব্দী ধরে যা চলে আসছে – একবার ধ্বংস আরেকবার নির্মাণ – এই চক্র থেকে আজ রাম জন্মভূমি মুক্তি পেল। এই উপলক্ষ্যে ১৩০ কোটি ভারতবাসীকে আমার প্রণাম।”
রামচন্দ্রকে ভারতীয় সংস্কৃতির আধার বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
তার কথায়, “ভগবান শ্রীরামের মন্দির আমাদের সংস্কৃতির আধুনিক প্রতীক, শাশ্বত আস্থার প্রতীক হয়ে উঠবে। এই মন্দির কোটি কোটি মানুষের মিলিত শক্তির প্রতীক হয়ে উঠবে।”
ভাষণের আগে ভূমিপুজো করে তিনি প্রস্তাবিত মন্দিরটির গর্ভগৃহ যেখানে তৈরি হবে, সেখানে একটি রুপার ইট রাখেন।
প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে বুধবারই নরেন্দ্র মোদী প্রথমবার অযোধ্যায় গিয়েছিলেন।
সেখানে পৌঁছে তিনি কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মন্দির পরিদর্শন করেন।
মি. মোদী ছাড়া ভূমিপুজোর কাছাকাছি রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের প্রধান মোহন ভগবত এবং উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ সহ অতি বিশিষ্ট কয়েকজন হাজির ছিলেন। উপস্থিত ছিলেন প্রায় তিনদশক ধরে চলতে থাকা রামমন্দির আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত সাধু-সন্তরাও।
তবে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সময়ে রামমন্দির আন্দোলনের নেতৃত্ব যারা দিয়েছিলেন, সেই লালকৃষ্ণ আদভানি বা মুরলী মনোহর যোশী এদিন অযোধ্যায় যাননি।
আমন্ত্রণ যায়নি রামমন্দির আন্দোলনের আরেক শরিক মহারাষ্ট্রের শিবসেনা দলকেও। তারা ভূমিপুজো চলাকালীনই জানান, “কর সেবকদের আত্মত্যাগ যারা রামমন্দিরের ভূমিপুজোর দিনে ভুলে যায়, তাদের ‘রামদ্রোহী’ বলা উচিত।”
করোনা মহামারির জন্য ভারতে এখন ধর্মীয় জমায়েত নিষিদ্ধ থাকলেও প্রস্তাবিত রামমন্দিরের ভূমিপুজো অনুষ্ঠানের আশপাশে হাজার হাজার ভক্ত হাজির হয়েছিলেন।
অযোধ্যায় উপস্থিত বিবিসি-র সংবাদদাতা সর্বপ্রিয়া সাঙ্গোয়ান জানাচ্ছেন, তাদের বেশিরভাগই সামাজিক দূরত্ব বিধি বা মাস্ক পরার নিয়ম মানেননি।
রামমন্দির নির্মান উপলক্ষে সারা দেশেই হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলির নেতাকর্মীরা উৎসব করেছেন। অন্যদিকে ভারতের মুসলমানদের অনেকেই দিনটিকে কালাদিবস হিসাবে পালন করছেন নিজেদের সামাজিক মাধ্যমের প্রোফাইল কালো রঙ দিয়ে।
অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড এক টুইট করে জানিয়েছে, “বাবরি মসজিদ একটা মসজিদ ছিল আর থাকবে। আয়া সোফিয়া আমাদের কাছে একটা বড় উদাহরণ।”
“অনায্য, লজ্জাজনক এবং সংখ্যাগরিষ্ঠকে খুশি করার মতো একটি রায়ের সুযোগ নিয়ে জমির দখল নেওয়া হলেও তার অবস্থান বদলাতে পারবে না কেউ। ভেঙ্গে পড়বেন না। অবস্থা চিরকাল একরকম থাকবে না।”
বাবরি মসজিদ আর রামজন্মভূমির জমি নিয়ে যে মামলা সুপ্রীম কোর্ট অবধি গড়িয়েছিল, তাতে মুসলিম পক্ষের হয়ে প্রধান আইনী লড়াই চালিয়েছেন লখনৌয়ের প্রবীণ আইনজীবি জাফরইয়াব জিলানি।
তিনি বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, “সুপ্রীম কোর্ট তো মেনেই নিয়েছে যে ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ভাঙ্গা হয়েছিল। সেই ঘটনারও নিন্দা করেছিল সর্বোচ্চ আদালত। সেখানে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী আজ কী করে বলছেন যে ওখানে কয়েক শতাব্দী ধরে রামলালা অবস্থান করছেন!”
“আর আজ সংবিধানকে অন্যভাবেও বুড়ো আঙ্গুল দেখানো হল – একটা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ধর্ম নিরপেক্ষ দেশের প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী, রাজ্যের গর্ভনর কীভাবে উপস্থিত থাকেন!! এটা যদি শুধু ধর্মীয় অনুষ্ঠান হত, তাতে কিছু বলার ছিল না, কিন্তু এটা তো সরকারী অনুষ্ঠান ছিল,” বলছিলেন জাফরইয়াব জিলানি।
তবে অনেক মুসলমানই মনে করেন যে সুপ্রীম কোর্টের রায়কে সম্মান জানানোই উচিত।
যদিও রামমন্দির নির্মাণের আজকের অনুষ্ঠানকে একটি রাজনৈতিক অনুষ্ঠান বলে মন্তব্য করছিলেন ভারতীয় মুসলিম মহিলা আন্দোলনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা জাকিয়া সোমান।
মিজ. সোমানের কথায়, “সুপ্রীম কোর্ট মন্দির মসজিদ বিতর্ক নিয়ে যে রায় দিয়েছে, তাকে সম্মান জানানোই উচিত। কিন্তু আজ যে অনুষ্ঠান হল, তা থেকে রাজনৈতিক অনুষ্ঠানের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। আসলে রামজন্মভূমি নিয়ে যে আন্দোলন হয়েছে, তা তো রাজনৈতিক কর্মকান্ডই ছিল।”
সুত্র: বিবিসি বাংলা