পাসপোর্ট-বিতর্কের অন্তরালে

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী:
বাংলাদেশ কখনও বিতর্কমুক্ত হবে না। সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে নিয়ে বিতর্কটি শেষ না হতেই নতুন একটি বিতর্ক শুরু হয়েছে। এর নাম দেওয়া যায় পাসপোর্ট-বিতর্ক। এই বিতর্ক আরও গুরুতর। এতদিন বাংলাদেশ ই-পাসপোর্টে পরিস্কারভাবে লেখা ছিল- বাংলাদেশের পাসপোর্টধারী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যাতায়াত করতে পারবে একমাত্র ইসরায়েল ছাড়া। বাংলাদেশের জন্ম থেকে ইসরায়েল সম্পর্কে এই নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশ পাসপোর্টে বহাল আছে। বঙ্গবন্ধু স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছিলেন, ‘আরব ভূমি অবৈধভাবে দখল করে ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা। আমরা প্যালেস্টাইনি আরবদের ওপর অবৈধভাবে জেঁকে বসা ইসরায়েল রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেব না’।
এই একই কথা বলেছিলেন ভারত স্বাধীন হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। তিনি অত্যাচারিত প্যালেস্টাইনি আরবদের প্রতি সমর্থন ঘোষণা করে ইসরায়েলকে কোনো বৈধতা দিতে চাননি এবং দেননি। মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরবসহ মিসর, সিরিয়া, লিবিয়া সব দেশ ছিল ইসরায়েলের বিরুদ্ধে। প্রেসিডেন্ট নাসেরের আমলে মিসর দুই দুইবার ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। ইরাকে সাদ্দাম হোসেন প্রেসিডেন্ট থাকাকালে ইসরায়েলের সঙ্গে একবার যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর আমলে বাংলাদেশ প্যালেস্টাইনিদের সামরিক সাহায্য পাঠাতে পারেনি। কিন্তু খাদ্য, ওষুধ এবং অন্যান্য সাহায্যসামগ্রী পাঠিয়েছিল।
এগুলো হলো বহু বছর আগের ঘটনা। এখন পৃথিবী একেবারেই বদলে গেছে। ভালোর দিকে বদলেছে এমন কথা বলব না। মন্দের দিকেও আমূল বদলে গেছে। নেহরু, নাসের, মুজিব, ইন্দিরা কেউ এখন বেঁচে নেই। ভারতে উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা ক্ষমতায় বসেছে এবং দীর্ঘকাল আগে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়ে তার সঙ্গে সামরিক ও অসামরিক লেনদেন শুরু করেছে। আমেরিকার ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট পদে থাকার সময়ে নব্য মার্কিন ফ্যাসিবাদের অভ্যুদয় ঘটে। ট্রাম্পের চাপে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ মুসলিম দেশ (ইরান ও সিরিয়া ছাড়া) ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়। প্যালেস্টাইনিরা নিঃস্ব ও অসহায় হয়ে পড়ে। এবারের গাজায় যুদ্ধে প্রমাণিত হলো, হামাস তাদের পক্ষে একটি শক্তিশালী সমর্থক গোষ্ঠী।
মধ্যপ্রাচ্যের সব মুসলিম শাসকগোষ্ঠী ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেওয়ার পর আমার মনে এই প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল, বাংলাদেশ এখন কী করবে? সেও কি ট্রাম্পের চাপে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেবে? না একটি ছোট দেশ হয়েও ট্রাম্পের চাপ অগ্রাহ্য করে এককভাবে ইসরায়েলের বিরোধিতায় অটল থাকবে? ট্রাম্প অথবা আমেরিকা শেখ হাসিনার ওপর প্রকাশ্যে এ চাপ হয়তো দেয়নি। অপ্রকাশ্যে দিয়েছে কিনা জানি না। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়েছিল, ইসরায়েলের মতো আরবদের অধিকার হরণকারী এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের লেজুড় দেশটিকে স্বীকৃতি না দেওয়ার ব্যাপারে শেখ হাসিনা তার চরিত্রের সাহস ও দৃঢ়তা দেখিয়েছেন।
তারপর রহস্যজনকভাবে কী ঘটল? বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়নি। কিন্তু বাংলাদেশ ই-পাসপোর্টে বিভিন্ন দেশে ভ্রমণের ব্যাপারে ইসরায়েলে গমনাগমনে যে নিষেধাজ্ঞা ছিল, তা তুলে নেওয়া হয়েছে। পাসপোর্টে ইসরায়েল নামটি আর নেই। ইসরায়েল তাতে খুশি হয়েছে। তেল আবিবের পত্রপত্রিকায় বাংলাদেশের ই-পাসপোর্টে এই পরিবর্তনকে অভিনন্দন জানানো হয়েছে। ঢাকায় মর্মাহত প্যালেস্টাইনি কূটনীতিক পাসপোর্টের এই পরিবর্তনে দুঃখ প্রকাশ করে হাসিনা সরকারকে বিষয়টি পুনর্বিবেচনার আবেদন জানিয়েছেন।
প্রথমে দেখা গেল বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পাসপোর্টের এই পরিবর্তনের কথা জানে না। সাংবাদিকরা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি প্রথমে বলেন, তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে বিষয়টি জানতে চাইবেন। জানার পর সাংবাদিকদের জানালেন ইসরায়েলকে বাংলাদেশ স্বীকৃতি দেয়নি, কেবল বাংলাদেশের পাসপোর্টকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার জন্য এটা করা হয়েছে। পরে প্যালেস্টাইনের কূটনীতিকের আবেদনের কথা শুনে তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে বলেছেন, বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। সে তার পাসপোর্টে কী লেখা থাকবে তা নিয়ে অন্য কারও ডিকটেশন শুনবে না।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী অত্যন্ত বিবেচক ব্যক্তি। তিনি প্যালেস্টাইনি ডিপ্লোম্যাটের সবিনয় আবেদন সম্ভবত ভালোভাবে জানেননি। জানলে ক্রোধ প্রকাশ করতে পারতেন না। তাছাড়া ই-পাসপোর্টে ইসরায়েলের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে তার আন্তর্জাতিক মান বাড়ানোর জন্য, সরকারের এই মন্তব্য হাস্যকর। তাহলে গত ৫০ বছর বাংলাদেশের পাসপোর্টের কী আন্তর্জাতিক মান ছিল না? ইসরায়েলে ভ্রমণে যাওয়ার নিষেধাজ্ঞা তুলে দেওয়ার পর আন্তর্জাতিক মান বেড়ে গেল? আমাদের স্বরাষ্ট্র এবং পররাষ্ট্র দুই মন্ত্রণালয়কেই অনুরোধ জানাব, এমন হাস্যকর যুক্তি যেন তারা না দেখায়।
বাংলাদেশের পাসপোর্ট থেকে ইসরায়েলে যাওয়ার নিষেধাজ্ঞা ধারা তুলে নেওয়া যে ইসরায়েলকে অঘোষিতভাবে স্বীকৃতি দেওয়া- এ কথাটি আমাদের স্বরাষ্ট্র অথবা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কি জানা নেই? এখন বিএনপি-জামায়াতের প্রোপাগান্ডার ঠেলায় পড়ে তারা বলছে, ইসরায়েলকে আমরা স্বীকৃতি দেইনি। বর্তমান পাসপোর্ট নিয়ে কেউ ইসরায়েলে গেলে তাকে কঠিন শাস্তি দেওয়া হবে।
কিন্তু সরকার কোন আইনে তাদের শাস্তি দেবে? কেন দেবে? আমার মনে হয়, ইসরায়েল সম্পর্কে সরকার নীতি পরিবর্তন করেছে। সৌদি আরবসহ আরব দেশগুলো ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেওয়ার পর বাংলাদেশের ওপর তার প্রভাব পড়েছে। জনমতের বিরোধিতা তীব্র ও কঠোর হবে এ কথা বুঝতে পেরে সরকার এই পর্দার আড়ালের খেলাটি খেলেছে। ধরা পড়ে এখন বলছে, আমরা ইসলায়েল সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর ঘোষিত নীতি থেকে সরে আসিনি। এবারের গাজা যুদ্ধেও আমরা ইসলায়েলের বর্বরতার তীব্র নিন্দা করেছি। বিপন্ন গাজায় নানা সাহায্যসামগ্রী পাঠিয়েছি।
সরকার গাজায় ইসরায়েলি বর্বরতার কঠোর সমালোচনা করেছে এ কথা সত্য। কিন্তু একটা স্বীকৃতিপ্রাপ্ত দেশকে আমরা তাদের কাজের জন্য সমালোচনা করে থাকি। ইরাক যুদ্ধের জন্য বাংলাদেশ সরকার অবশ্যই ব্রিটেন ও আমেরিকার তীব্র সমালোচনা করেছে। দুটি দেশই বাংলাদেশের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ও সাহায্যদাতা দেশ। বর্তমানে ইসরায়েলের সঙ্গে এ ধরনের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা সরকার চাইতে পারে। দেশের স্বার্থে যদি প্রয়োজন হয় বাংলাদেশ সরকার ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিলে আপত্তির কোনো কারণ নেই। বিশ্ব পরিস্থিতি বদলে গেছে। ৫০ বছর আগের পুরোনো নীতি আঁকড়ে বসে থাকা অর্থহীন।
সরকার যদি ইসরায়েলের বর্বর চরিত্রের কথা জেনেও দেশটির সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক স্থাপন করতে চায়, তাহলে দেশবাসীকে তা জানিয়ে তাদের সমর্থন আদায় করে সে কাজ অবশ্যই করতে পারে। তা না করে জনগণকে অন্ধকারে রেখে এই কাজ কেন? এই লুকোচুরির জন্য সরকার জনগণের বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবে। প্যালেস্টাইনের নির্যাতিত আরবদের কাছেও এই খেলা বেশিদিন লুকিয়ে রাখা যাবে না। তখন আমরা যতই বলি, আমরা ইসরায়েলের মিত্র নই, আমরা প্যালেস্টাইনিদের পক্ষে, এ কথা তারা বিশ্বাস করবে না। বাংলাদেশের পাসপোর্টে ইসরায়েলে যাওয়া নিষিদ্ধ করে যে ক্লজটি ছিল, তা তুলে দেওয়ায় ইতোমধ্যে ইসরায়েলের রাজধানী তেল আবিবের পত্রিকাগুলো আনন্দ প্রকাশ করেছে এবং বাংলাদেশকে অভিনন্দন জানিয়েছে। এ খবর প্যালেস্টাইনিদের কানে না যাওয়ার কোনো কারণ নেই।
আমার একটি সন্দেহ হয়, পাসপোর্টে ইসরায়েলে গমন-সংক্রান্ত ধারা বদল প্রধানমন্ত্রী শেখ হসিনার অগোচরে সুকৌশলে করা হয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন যে প্রথমে এটা জানতেন না, তা নিজেই বলেছেন। তা হলে এটা কি আমলাদের মামলা? অর্থাৎ স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের শীর্ষস্থানীয় আমলাদের মিলিত কীর্তি? প্রশ্নটি তুলছি এ জন্য যে, বাংলাদেশে বিএনপি ও জামায়াতের বদৌলতে একটা ভারতবিদ্বেষী দীর্ঘস্থায়ী জনমত তৈরি হয়েছিল। শেখ হাসিনা সাহসের সঙ্গে এই ভারতবিদ্বেষী জনমত মোকাবিলা করছেন এবং ভারতের বিজেপির মতো সরকারের সঙ্গে দু’দেশেরই স্বার্থে অটুট মৈত্রী গড়েছেন।
এই শেখ হাসিনা যদি ইসরায়েলের সঙ্গে দেশের স্বার্থে সম্পর্ক স্থাপন করতে চাইতেন, তা হলে নিজের দেশের জনগণকে জানাতেন। তাদের সমর্থন নিয়ে ইসরায়েলের সঙ্গে মৈত্রী প্রতিষ্ঠায় এগোতেন। এই গোপন খেলা খেলতেন না। এটা অবশ্যই আমলাদের খেলা। শেখ হাসিনার মতো অভিজ্ঞ রাজনীতিকের পক্ষে এ মুহূর্তে বর্বর ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক পাতানো সম্ভব নয়, যখন গাজা যুদ্ধে অকল্পনীয় বর্বরতা দেখিয়ে ইসরায়েল সারাবিশ্বের ধিক্কার ও নিন্দা অর্জন করেছে। এমনকি আমেরিকার জনমত পর্যন্ত ঘোর ইসরায়েলবিরোধী। মধ্যপ্রাচ্যের দ্বিতীয় হিটলার নেতানিয়াহু কতদিন ক্ষমতায় থাকতে পারবেন, তা সন্দেহজনক।
ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বহির্বিশ্বের জনমত যেভাবে গর্জে উঠেছে, সেভাবে ইসরায়েলে বসবাসকারী আরব নাগরিকরাও ইসরায়েল সরকার ও জায়নিস্টদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শনের জন্য রাস্তায় নেমেছে। ইসরায়েলের তেল আবিবসহ বিভিন্ন শহরে আরব-ইহুদিদের মধ্যে প্রচণ্ড দাঙ্গা হয়েছে। একটি ইসরায়েলি শহরের মেয়র এটাকে বলেছেন সিভিল ওয়ার। এই সিভিল ওয়ারেই ইসরায়েল ধ্বংস হবে বলে কেউ কেউ ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। আমেরিকার নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীও বলেছেন, ‘দুই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই সমস্যার সমাধান ঘটাবে।’ অদূর ভবিষ্যতে স্বাধীন সার্বভৌম প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র যে হতে যাচ্ছে, তাতে সন্দেহ নেই। নেতানিয়াহুর পতনও আসন্ন।
এই সময়ে শেখ হাসিনার মতো অভিজ্ঞ রাজনৈতিক নেতা যাবেন ইসরায়েলের সঙ্গে প্রকাশ্যে অথবা অপ্রকাশ্যে মিতালি পাতাতে, তা আমি বিশ্বাস করি না। তাই আমাদের পাসপোর্ট-সংক্রান্ত রহস্যটি উন্মোচিত হওয়া দরকার। কোন আমলাচক্র দেশের স্বার্থ ও সুনাম নিয়ে ছেলেখেলায় মেতেছে, সময় থাকতে তাদেরও মুখোশ উন্মোচন দরকার।
সৌজন্যে: সমকাল